পাকিস্তানের সবচেয়ে গোপনীয় পারমাণবিক কর্মসূচির তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল নাপিতের দোকানের মেঝেতে পড়ে থাকা চুলের নমুনা থেকে। ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এই অসাধারণ অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানের গোপন পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রমাণ সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেসাইয়ের এক টেলিফোন কলের কারণে এই গুপ্তচর নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার পর পাকিস্তান তার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গোপন কর্মসূচি শুরু করেছিল। কাহুতায় খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ স্থাপিত হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানের এই গোপন পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ সংগ্রহ করা ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
র’-এর কাহুতা অপারেশনে গুপ্তচর এজেন্টরা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে কাহুতা শহরের নাপিতের দোকানগুলোতে যেতেন। কাহুতা পারমাণবিক সুবিধায় কাজ করা বিজ্ঞানীরা নিয়মিত এসব দোকানে চুল কাটাতে আসতেন। গুপ্তচররা এসব দোকানের মেঝে থেকে কেটে পড়ে থাকা চুলের নমুনা সংগ্রহ করতেন এবং গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিতেন।
এই চুলের নমুনাগুলো ভারতের ভাবা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। পরীক্ষার ফলাফল চমকপ্রদ ছিল – চুলে তেজস্ক্রিয়তা এবং ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে পাকিস্তান অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রযুক্তি অর্জন করেছে।
অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই গুপ্তচরবৃত্তির কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। তিনি ১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তানে গোপনে অবস্থান করেছিলেন ছয় বছর। ডোভাল একজন ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কাহুতা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন এবং কৌশলে নাপিতের দোকান থেকে বিজ্ঞানীদের চুলের নমুনা সংগ্রহ করতেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এই তথ্যের ভিত্তিতে আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন যে ভারতের কাছে “অত্যন্ত নিশ্চিত, ভৌত তথ্য রয়েছে যে পাকিস্তানিদের কাছে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, যা সহজেই পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।”
কিন্তু এই সফল গুপ্তচরবৃত্তির পরিণতি হয়েছিল বিপর্যয়কর। ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেসাই একটি টেলিফোনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন যে ভারত পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত। দেসাই জিয়ার কাছে র’-এর পাকিস্তানের নেটওয়ার্কের বিস্তারিত তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন।
মোরারজি দেসাই র’-এর প্রতি অবিশ্বাস রাখতেন এবং এটিকে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত হাতিয়ার মনে করতেন। তিনি র’-এর বাজেট ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিলেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান রমেশ্বর নাথ কাওকে ছুটিতে পাঠিয়েছিলেন। গান্ধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসী দেসাই মনে করতেন প্রতিবেশীদের সাথে সততা বজায় রাখা প্রয়োজন।
দেসাইয়ের এই তথ্য ফাঁসের পরিণতি ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক অবিলম্বে পাকিস্তানের ভিতরে র’-এর সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। অসংখ্য ভারতীয় গুপ্তচর ধরা পড়েছিলেন, নিহত হয়েছিলেন অথবা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরও গভীরে ভূগর্भস্থ করে নিয়ে গিয়েছিল এবং নিরাপত্তা আরও কঠোর করেছিল।
এই ঘটনার ফলে যে র’ এজেন্ট কাহুতার পারমাণবিক কর্মসূচির সম্পূর্ণ নকশা প্রদানে রাজি হয়েছিলেন, তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। এটি ছিল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে দেসাইয়ের এই ভুলের কারণে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা প্রায় ১৫ বছর এগিয়ে গিয়েছিল।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও এই অভিযানে র’-কে সহায়তা করেছিল। এমনকি ইসরায়েল কাহুতা সুবিধায় বিমান হামলার জন্য ভারতের কাছে জ্ঞালানি সরবরাহের সুবিধা চেয়েছিল। কিন্তু মুম্বাইয়ে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশে দায়ানের সাথে গোপন বৈঠকে দেসাই সেই সুবিধা প্রদান করতে অস্বীকার করেছিলেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে র’ পাকিস্তানে তার নেটওয়ার্ক পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে অপারেশন ব্রাসট্যাকসের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী কাহুতায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। পরে কার্গিল যুদ্ধের সময় র’ পাকিস্তানি সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের টেলিফোন কথোপকথন আটকাতে সফল হয়েছিল।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে গুপ্তচরবৃত্তিতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি সাধারণ টেলিফোন কল কীভাবে বছরের পর বছরের কঠিন পরিশ্রম এবং অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পারে। পাকিস্তানের পারমাণবিক গোপনীয়তা উন্মোচনের জন্য র’-এর এই চুলের নমুনা সংগ্রহের কৌশল ছিল গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
বর্তমানে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি এবং নিরাপত্তা লঙ্ঘনের নতুন ঘটনা ঘটছে, তখন এই ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গোপনীয়তা রক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত কীভাবে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।