ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা এক নতুন মোড় নিয়েছে। ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান চালিয়েছে তাদের ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, এটি ভারতের হামলার প্রতিশোধ স্বরূপ। পাকিস্তানের এই অপারেশনের নাম – ‘বানিয়ান মারসুস’ – একটি আরবি শব্দবন্ধ যার অর্থ “দৃঢ় প্রাচীর” বা “অটল দেয়াল”। এই নামটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি ইসলামিক ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সাম্প্রতিক পটভূমি
২০২৫ সালের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিল ২২, ২০২৫ তারিখে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পাহলগাম এলাকায় একটি ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়। এই হামলার দায় স্বীকার করে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামক একটি সংগঠন, যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে। ভারতের অভিযোগ, টিআরএফ আসলে পাকিস্তান ভিত্তিক লশকর-ই-তৈবা (এলইটি) সংগঠনের একটি শাখা। পাকিস্তান অবশ্য এই হামলার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে এবং একটি নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’: উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
পাহালগাম হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত মে ৭, ২০২৫ তারিখে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে পরিচিত হয়। এই অপারেশনের নামকরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘সিন্দুর’ হল হিন্দু বিবাহিত মহিলাদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি প্রতীকী লাল গুঁড়ো, যা বিবাহিত অবস্থার প্রতীক। ভারত সরকারের এই নামকরণের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল সেই সমস্ত বিধবাদের প্রতিশোধ নেওয়া যারা সন্ত্রাসবাদী হামলায় তাদের স্বামীদের হারিয়েছেন।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী একটি সমন্বিত ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিল যা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চলে নয়টি নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থল টার্গেট করেছিল। এর মধ্যে ছিল লাহোরের কাছাকাছি মুরিদকে এবং বাহাওয়ালপুরের মতো বড় শহরতলি এলাকা। এটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর থেকে ভারতের দ্বারা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে চালানো প্রথম আক্রমণ।
ভারতের লক্ষ্যস্থল ও তাদের তাৎপর্য
ভারতের টার্গেট করা স্থানগুলি ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, মুরিদকেতে ভারতের দাবি অনুসারে জামাত-উদ-দাওয়া’র সদর দপ্তর রয়েছে, যা ভারতের মতে লশকর-ই-তৈবার একটি প্রচ্ছন্ন সংগঠন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাবি, এখানে মারকাজ তৈবা সুবিধায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানা হয়েছে, যেখানে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সাথে জড়িত প্রধান ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল।
পাকিস্তানের ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’: পাল্টা জবাব
ভারতের হামলার জবাবে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে, যা তারা ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ নামে অভিহিত করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্ট (আইএসপিআর) এর মতে, এই পাল্টা অভিযান ভারতের তিনটি বিমান ঘাঁটিতে আঘাত হানার অভিযোগের পরে শুরু হয়েছে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট আহমেদ শরিফ চৌধুরীর মতে, ভারতের আক্রমণে ছয়টি শহরে কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়েছেন। তার অভিযোগ অনুযায়ী, মসজিদ এবং আবাসিক এলাকাগুলিও লক্ষ্য করা হয়েছিল, যার ফলে বেসামরিক ব্যক্তি, নারী ও শিশুসহ অনেক হতাহত হয়েছে।
বানিয়ান মারসুস: অর্থ ও তাৎপর্য
বানিয়ান মারসুসের অর্থ কী?
‘বানিয়ান মারসুস’ (বা ‘বুনিয়ান মারসুস’) আরবি ভাষায় একটি শব্দবন্ধ যার অর্থ “দৃঢ় প্রাচীর” বা “অটল দেয়াল”। এই শব্দটি একটি হাদিস (মহানবী মুহাম্মদ (সা:)-এর বাণী) থেকে উদ্ধৃত, যেখানে বলা হয়েছে “বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক বুনিয়ান মারসুসের মতো” – অর্থাৎ একটি মজবুত, অভেদ্য দেয়ালের মতো।
ঐতিহাসিক ব্যবহার
আশ্চর্যজনকভাবে, ‘বুনিয়ান মারসুস’ নামটি এর আগেও একটি সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৬ সালে, লিবিয়ার ন্যাশনাল একর্ড সরকার (জিএনএ) এর বুনিয়ান মারসুস অপারেশন রুম আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিল। মিসরাতান কর্নেল বশির আল গাদির নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল এবং সিরতে আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য
পাকিস্তানের দ্বারা এই নাম বেছে নেওয়া সম্ভবত তাদের দৃঢ় অবস্থান এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘দৃঢ় প্রাচীর’ নামকরণের মাধ্যমে পাকিস্তান সম্ভবত এটি বোঝাতে চেয়েছে যে তারা ভারতের যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এছাড়া, ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে নাম নেওয়ার মাধ্যমে, পাকিস্তান সম্ভবত তাদের ধর্মীয় পরিচয়কেও সামনে আনতে চেয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পরিস্থিতি
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল) বরাবর পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাতে সীমান্ত জুড়ে গোলাগুলির বিষয়ে অনেক সাক্ষ্য সামনে এসেছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের কুপওয়াড়া ও উরি জেলার বাসিন্দারা এই গোলাগুলির ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
কুপওয়াড়ার ক্রালপোরার বাসিন্দা তানভির আহমদ জানিয়েছেন, “আমরা কখনও এই গ্রামে গোলা পড়তে দেখিনি, এটা আমার জীবনে প্রথম ঘটনা।” শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৫:০০ টায় তার বাড়িতে একটি গোলা আঘাত করে, যা তার ট্রাক এবং পরিবারের মালিকানাধীন একটি মাটি খনক যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে।
উরিতেও বাসিন্দারা এলাকায় তীব্র গোলাবর্ষণের কথা জানিয়েছেন। উরির নিসার হুসেন একটি ভয়েস মেসেজে বর্ণনা করেছেন যে বৃহস্পতিবার রাত ৯:০০ টায় শুরু হওয়া গোলাবর্ষণ সারা রাত চলেছিল। “আমরা একটি মসজিদের বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম, যা গ্রামবাসীরা এক দশক আগে নির্মাণ করেছিল,” নিসার ব্যাখ্যা করেছেন। “সকালে ফিরে এসে আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার বাড়ির কাছে তিনটি গোলা পড়েছে, যার ফলে ক্ষতি হয়েছে।”
উরির একজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ফারহান লোন মন্তব্য করেছেন যে এলাকাটি “একটি ভূতের শহরে পরিণত হয়েছে – প্রায় ৯০% বাসিন্দা ইতিমধ্যে স্থান ত্যাগ করেছে।”
দুই দেশের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনার প্রভাব
বর্তমান উত্তেজনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এই ধরনের সংঘাত আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই করা চারটি যুদ্ধের বাইরে পাকিস্তানী অঞ্চলে ভারত দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে ব্যাপক সামরিক অভিযানগুলির মধ্যে একটি।
পূর্ববর্তী বিমান হামলার বিপরীতে, এই সিরিজের আক্রমণে উল্লেখযোগ্য শহুরে এলাকাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, লাহোর – পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের কাছে অবস্থিত মুরিদকে ছিল লক্ষ্যবস্তুগুলির মধ্যে একটি। বাথিওয়ালক এবং বাহাওয়ালপুরও প্রধান শহুরে কেন্দ্র।
অপারেশন সিন্দুর বনাম অপারেশন বানিয়ান মারসুস: নামের তাৎপর্য
দুটি অপারেশনের নামকরণ তাদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় পটভূমিকে প্রতিফলিত করে। ভারতের “অপারেশন সিন্দুর” একটি হিন্দু প্রতীক থেকে নেওয়া হয়েছে, যা বিবাহিত নারীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় এবং সম্ভবত সন্ত্রাসবাদী হামলায় স্বামী হারানো মহিলাদের প্রতিশোধের প্রতীক।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের “অপারেশন বানিয়ান মারসুস” ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত, যা একটি হাদিস থেকে উদ্ধৃত এবং মজবুত, অভেদ্য প্রতিরোধের প্রতীক। দুটি নামই তাদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান সংঘাত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “অপারেশন সিন্দুর” এবং “অপারেশন বানিয়ান মারসুস” এর নামকরণ শুধু সামরিক কৌশলই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতীকী তাৎপর্যও বহন করে।
‘বানিয়ান মারসুস’ শব্দের অর্থ “দৃঢ় প্রাচীর” বা “অটল দেয়াল” – যা একটি হাদিস থেকে উদ্ধৃত। পাকিস্তান এই নাম বেছে নিয়ে তাদের দৃঢ় প্রতিরোধের ইচ্ছা এবং ধর্মীয় পরিচয়কে তুলে ধরেছে। দুটি দেশের মধ্যে এই তীব্র উত্তেজনা কতদিন চলবে এবং এর পরিণতি কী হবে তা এখনও অনিশ্চিত।
সামরিক অভিযানের নামকরণ যেভাবে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়কে প্রতিফলিত করে, তা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান গভীর বিভাজন এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতীক। আশা করা যায়, উভয় দেশই কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এই সংঘাত সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।