Blood infection in children: প্রিয় অভিভাবক, আপনার সোনামণির জ্বর কমছে না? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? অস্বাভাবিক আচরণ করছে? এসব লক্ষণ দেখলে সতর্ক হোন। শিশুদের রক্তে ইনফেকশন একটি মারাত্মক জরুরি অবস্থা যা মিনিটের মধ্যে জীবনহানির কারণ হতে পারে। কিন্তু সঠিক জ্ঞান এবং দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে আপনি আপনার শিশুর জীবন বাঁচাতে পারেন। আজকের এই লেখায় আমরা জানব শিশুদের রক্তে ইনফেকশন হলে ঠিক কী করণীয়, কীভাবে চিনবেন এবং কীভাবে প্রতিরোধ করবেন।
শিশুদের রক্তে ইনফেকশন কী এবং কেন এত বিপজ্জনক?
শিশুদের রক্তে ইনফেকশন, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেপসিস বলা হয়, এমন একটি অবস্থা যেখানে সংক্রামক জীবাণু রক্তের মাধ্যমে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের কারণে হতে পারে।
যখন কোনো সংক্রমণ শরীরের স্থানীয় এলাকা থেকে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে, তখন শিশুর দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া শিশুর নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে।
বিশেষ করে নবজাতক এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি।
পায়ের নতুন নখ গজাতে কত সময় লাগে? — জানুন প্রয়োজনীয় তথ্য ও যত্নের উপায়
লক্ষণগুলো চেনার উপায়: সতর্কতার সংকেত
শিশুদের রক্তে ইনফেকশনের লক্ষণগুলো প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণ জ্বর-সর্দির মতোই মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখলে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে হবে:
তাৎক্ষণিক বিপদের সংকেত
- জ্বর বা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভব: ১০০.৪°F (৩৮°C) এর বেশি জ্বর বা শরীর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
- দ্রুত হৃদস্পন্দন: স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত হার্টবিট
- শ্বাসকষ্ট: দ্রুত শ্বাস নেওয়া বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- অস্বাভাবিক তন্দ্রাচ্ছন্নতা: শিশু অতিরিক্ত ঘুমিয়ে থাকা বা জাগানো কঠিন হওয়া
ত্বকের পরিবর্তন
- ত্বক ফ্যাকাশে, নীলাভ বা দাগযুক্ত হয়ে যাওয়া
- ত্বক স্পর্শ করলে ঠাণ্ডা লাগা
- চোখের চারপাশ কালো হয়ে যাওয়া
আচরণগত পরিবর্তন
- অস্বাভাবিক বিরক্তি বা কান্নাকাটি
- খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা
- প্রস্রাব কম হওয়া বা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া
মনে রাখবেন: SEPSIS শব্দটি দিয়ে মনে রাখতে পারেন – S (Slurred speech), E (Extreme shivering), P (Passing no urine), S (Severe breathlessness), I (“I feel like I might die”), S (Skin mottled)।
শিশুদের রক্তে ইনফেকশন হলে তাৎক্ষণিক করণীয়
প্রথম ৩০ মিনিট: জীবন বাঁচানোর সময়
১. অবিলম্বে নিকটস্থ হাসপাতালে যান
- ইমার্জেন্সি বিভাগে গিয়ে স্পষ্টভাবে বলুন আপনার সন্দেহ হচ্ছে শিশুর সেপসিস হয়েছে
- অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন যদি নিজে নিয়ে যেতে অসুবিধা হয়
২. পথে যেতে যেতে করণীয়
- শিশুকে আরামদায়ক অবস্থানে রাখুন
- শ্বাসকষ্ট হলে মাথা একটু উঁচু করে রাখুন
- কোনো ওষুধ খাওয়াবেন না ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া
৩. হাসপাতালে পৌঁছে
- শিশুর সব লক্ষণ এবং কখন থেকে শুরু হয়েছে তার একটি তালিকা দিন
- আগের কোনো অসুখ বা ওষুধের ইতিহাস জানান
হাসপাতালে চিকিৎসা পদ্ধতি
শিশুদের রক্তে ইনফেকশনের চিকিৎসা দ্রুততা এবং নিবিড় পরিচর্যার উপর নির্ভর করে। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলো:
অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি
- ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক অবিলম্বে শুরু করা হয়
- রক্ত কালচার রিপোর্ট পাওয়ার পর নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়
- প্রথম ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া জীবন বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
শিরায় তরল প্রবেশ
- শরীরে পানিশূন্যতা পূরণ এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য
- প্রথম ঘণ্টায় ৪০-৬০ মি.লি./কেজি তরল দেওয়া হতে পারে
সহায়ক চিকিৎসা
- অক্সিজেন থেরাপি
- প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ওষুধ
প্রতিরোধ: শিশুদের সুরক্ষার উপায়
টিকাদান কর্মসূচি
নিয়মিত টিকাদান শিশুদের রক্তে ইনফেকশন প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। গুরুত্বপূর্ণ টিকাগুলো:
- নিউমোনিয়া প্রতিরোধী টিকা
- হিব টিকা (Haemophilus influenzae type b)
- মেনিনজাইটিস প্রতিরোধী টিকা
- ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা
দৈনন্দিন সতর্কতা
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
- নিয়মিত হাত ধোয়া সাবান-পানি দিয়ে
- শিশুর খেলনা এবং ব্যবহার্য জিনিস পরিষ্কার রাখা
- অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে শিশুকে দূরে রাখা
পুষ্টিকর খাবার
- মায়ের দুধ খাওয়ানো প্রথম ৬ মাস
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী খাবার দেওয়া
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি
নবজাতকদের বিশেষ সতর্কতা
নবজাতকদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা প্রয়োজন:
- গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপ
- গ্রুপ বি স্ট্রেপটোকক্কাস (GBS) স্ক্রিনিং
- প্রসবের সময় পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা
- জন্মের পর অবিলম্বে টিকাদান শুরু
কখন জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার দেখাবেন
নিম্নলিখিত যেকোনো লক্ষণ দেখলে এক মিনিটও দেরি করবেন না:
- শিশুর শরীর অস্বাভাবিক গরম বা ঠাণ্ডা
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস
- চেতনা হারানো বা অস্বাভাবিক তন্দ্রাচ্ছন্নতা
- ত্বকের রঙ নীলাভ বা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব না হওয়া
মনে রাখবেন: শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ কমে যাওয়া অনেক দেরিতে হয়, তাই রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলেও অন্য লক্ষণগুলো থাকলে দেরি করবেন না।
পরিবারের সদস্যদের মানসিক প্রস্তুতি
শিশুদের রক্তে ইনফেকশন হলে পুরো পরিবারের উপর মানসিক চাপ পড়ে। এ সময় করণীয়:
- ধৈর্য রাখুন এবং ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলুন
- হাসপাতালে অবস্থানকালে পালাক্রমে দেখাশোনা করুন
- অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রাখুন
- চিকিৎসক দল এবং নার্সিং স্টাফদের সাথে নিয়মিত কথা বলুন
দীর্ঘমেয়াদী পরিচর্যা এবং ফলোআপ
হাসপাতাল থেকে ছাড়ার পর:
- নির্ধারিত সময়ে সব ওষুধ খাওয়ান
- ডাক্তারের নির্দেশিত সময়ে ফলোআপ করান
- শিশুর খাওয়া-দাওয়া এবং কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করুন
- কোনো নতুন লক্ষণ দেখলে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন
শিশুদের রক্তে ইনফেকশন একটি মারাত্মক অবস্থা হলেও সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। মূল চাবিকাঠি হলো দ্রুত সনাক্তকরণ এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। আপনার সতর্কতা এবং দ্রুত পদক্ষেপই পারে আপনার সোনামণির জীবন বাঁচাতে। নিয়মিত টিকাদান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পুষ্টিকর খাবার দিয়ে আপনি আপনার শিশুকে এই মারাত্মক রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।