কবুতর পোষেন? সাবধান! ফুসফুসে হতে পারে জীবন-বিপন্নকারী এই রোগ

কবুতর পালন বা কবুতরের সংস্পর্শে থাকা মানুষদের হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস নামক মারাত্মক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে । এই রোগটি "বার্ড ফ্যান্সিয়ার্স লাং" বা "পিজিয়ন ব্রিডার্স ডিজিজ" নামেও পরিচিত এবং…

Debolina Roy

 

কবুতর পালন বা কবুতরের সংস্পর্শে থাকা মানুষদের হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস নামক মারাত্মক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে । এই রোগটি “বার্ড ফ্যান্সিয়ার্স লাং” বা “পিজিয়ন ব্রিডার্স ডিজিজ” নামেও পরিচিত এবং দীর্ঘদিন ধরে কবুতরের পালক, মল এবং ত্বকের কণার সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুসে প্রদাহ ও স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে । ভারতে পরিচালিত একটি প্রসপেক্টিভ রেজিস্ট্রি অধ্যয়নে দেখা গেছে যে ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ (ILD) রোগীদের মধ্যে ৪৭.৩% এই হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসে আক্রান্ত, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ ।

হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস কী

হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস (HP) একটি অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়াজনিত ফুসফুসের রোগ যা পাখির প্রোটিন, ছত্রাক এবং অন্যান্য জৈব পদার্থের বারবার শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণের ফলে হয় । কবুতরের শুকনো মল, পালক এবং ত্বকের সূক্ষ্ম কণা থেকে নির্গত অ্যাভিয়ান প্রোটিন ফুসফুসে গ্র্যানুলোমা সৃষ্টি করে এবং প্রদাহ ঘটায় । এই রোগটি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত – তীব্র (acute), উপতীব্র (subacute) এবং দীর্ঘস্থায়ী (chronic) । দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ে ফুসফুসে স্থায়ী ফাইব্রোসিস বা দাগ তৈরি হয়, যা অপরিবর্তনীয় এবং শ্বাসকষ্টের কারণ হয় ।

বৈশ্বিক ও ভারতীয় পরিসংখ্যান

বিশ্বব্যাপী হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসের ঘটনা প্রতি ১,০০,০০০ জনসংখ্যায় ০.৩ থেকে ০.৯ জন । ফাইব্রোটিক HP এর প্রাদুর্ভাব প্রতি ১,০০,০০০ জনে ৬.৩ এবং নতুন ঘটনার হার ২.৫ । তবে ভারতে এই রোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ILD-India রেজিস্ট্রি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে নতুন ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৪৭.৩% হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসে আক্রান্ত । এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে পাখির সংস্পর্শ, কুলিং ডিভাইস (এয়ার কন্ডিশনার, হিউমিডিফায়ার) এবং ছত্রাকের উপস্থিতি ।

Indian Interstitial Lung Disease Registry অনুসারে, HP কেসগুলির মধ্যে মাত্র ২১.৪% ক্ষেত্রে পাখির সংস্পর্শ পাওয়া গেছে । মুম্বাইয়ের তিনটি প্রধান হাসপাতালে জুলাই ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৩৪ জন HP রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে এবং দুজনের মৃত্যু হয়েছে । দীর্ঘস্থায়ী পিজিয়ন ব্রিডার্স লাং (CPBL) রোগীদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের ৫ বছর পর বেঁচে থাকার হার ০.৭১ (৭১%) ।

Gallbladder Disease: অপারেশন ছাড়া গলব্লাডার পাথর অপসারণ: মিথ না বাস্তবতা?

কারণ ও ঝুঁকির উপাদান

কারণ বিবরণ ঝুঁকির মাত্রা
কবুতরের পালক পালকে থাকা প্রোটিন কণা শ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে উচ্চ
কবুতরের মল শুকনো মলের সূক্ষ্ম কণায় ছত্রাক ও অ্যালার্জেন থাকে অতি উচ্চ
দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শ প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কবুতরের সংস্পর্শে থাকা অতি উচ্চ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বলতা দুর্বল ইমিউন সিস্টেম গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় মাঝারি থেকে উচ্চ

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে কবুতর পালনকারীদের ক্ষেত্রে দৈনিক কবুতরের সংস্পর্শে থাকার সময়ের সাথে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা সূচক (FEV1, FVC, FEV1%, FVC%) এর নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে । যত বেশি সময় ধরে কবুতর পালন করা হয় এবং প্রতিদিন যত বেশি সময় সংস্পর্শে থাকা হয়, ফুসফুসের ক্ষতি তত বেশি হয় ।

উপসর্গ ও লক্ষণ

তীব্র পর্যায়ের উপসর্গ

তীব্র হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস সংস্পর্শের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফ্লুর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে । এর মধ্যে রয়েছে জ্বর, শুকনো কাশি, বুকে টান অনুভব এবং শ্বাসকষ্ট । এই উপসর্গ সাধারণত সংস্পর্শ বন্ধ হলে কমে যায়। তবে বারবার সংস্পর্শে এলে রোগ উপতীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ে চলে যেতে পারে।​

দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ের উপসর্গ

দীর্ঘস্থায়ী HP ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং এর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে ক্রমাগত কাশি, পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট, অবসাদ এবং ওজন হ্রাস । ২০২৪ সালে দিল্লির স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে একটি ১১ বছর বয়সী ছেলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে দীর্ঘদিন কবুতরের পালক ও মলের সংস্পর্শে থাকার কারণে তার ফুসফুসে প্রদাহ এবং দাগ তৈরি হয়েছিল । এই পর্যায়ে পালমোনারি ফাইব্রোসিস হতে পারে যা সবচেয়ে গুরুতর জটিলতা ।

রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া

HP নির্ণয়ের জন্য বেশ কয়েকটি পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। প্রথমত, রোগীর পরিবেশগত সংস্পর্শের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয় । তারপর বুকের এক্স-রে এবং HRCT স্ক্যান করা হয় যা ফুসফুসে গ্র্যানুলোমা এবং প্রদাহ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে । পালমোনারি ফাংশন টেস্ট (PFT) করে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরিমাপ করা হয় । কবুতর সিরাম প্রোটিন, পালক এবং মলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয় । কিছু ক্ষেত্রে ব্রঙ্কোঅ্যালভিওলার ল্যাভেজ (BAL) বা ফুসফুসের বায়োপসি প্রয়োজন হতে পারে ।

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

প্রধান চিকিৎসা

হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসের একমাত্র সুপারিশকৃত দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা হলো কবুতর এবং অন্যান্য পাখির সংস্পর্শ সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা । রোগীকে ঘর থেকে সব পাখি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং পালকযুক্ত বিছানা, বালিশ, আউটওয়্যার এবং স্লিপিং ব্যাগও সরাতে হবে । গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাখি অপসারণের পরেও পাখির অ্যান্টিজেন ১৮ মাস পর্যন্ত ঘরে উচ্চ মাত্রায় থাকতে পারে । তাই সমস্ত নরম আসবাবপত্র, দেওয়াল, সিলিং এবং আসবাব ভালোভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন ।

ওষুধ চিকিৎসা

অ্যান্টিজেন এড়িয়ে চলার পরেও যদি রোগ অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে সিস্টেমিক কর্টিকোস্টেরয়েড (স্টেরয়েড ওষুধ) দেওয়া হয় । এটি ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে । কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে । তীব্র বা উপতীব্র পর্যায়ের HP চিকিৎসায় সেরে যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে পালমোনারি ফাইব্রোসিসে অগ্রসর হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে ফুসফুস প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে ।

হাঁপানি আক্রমণ প্রতিরোধ: ১৫টি টিপস যা আপনাকে সহজে শ্বাস নিতে সাহায্য করবে

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

কবুতর পালনকারী এবং কবুতরের সংস্পর্শে আসেন এমন ব্যক্তিদের জন্য প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কবুতর পালনের সময় সর্বদা মাস্ক ও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত । কবুতরের খাঁচা বা বাসস্থান নিয়মিত পরিষ্কার করা এবং সঠিক বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কবুতরের সংস্পর্শের পর হাত ভালোভাবে ধোয়া এবং পোশাক পরিবর্তন করা উচিত। যাদের শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের কবুতর পালন এড়িয়ে চলা উচিত। কবুতর খাওয়ানোর জন্য ব্যাপক প্রচলিত ভারতীয় সংস্কৃতির কারণে অনেকে জানেন না যে এটি স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায় ।

অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি

হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস ছাড়াও কবুতরের মল থেকে আরও কয়েকটি রোগ হতে পারে। ক্রিপ্টোকক্কোসিস একটি ছত্রাক সংক্রমণ যা নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিস হতে পারে । হিস্টোপ্লাজমোসিস আরেকটি ছত্রাক সংক্রমণ যা শুকনো কবুতরের মলে থাকা Histoplasma capsulatum ছত্রাকের স্পোর শ্বাসের সাথে নিলে হয় । কবুতরের মলে থাকা ব্যাকটেরিয়া শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটাতে পারে । কবুতরের মলের প্রোটিন অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে হাঁপানি এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে ​

রোগের পূর্বাভাস

হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসের পূর্বাভাস নির্ভর করে রোগ নির্ণয়ের সময়, তীব্রতা এবং চিকিৎসায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতার উপর। তীব্র পর্যায়ের রোগীদের পূর্বাভাস সবচেয়ে ভালো এবং সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সেরে যেতে পারে । দীর্ঘস্থায়ী রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে । মৃত্যুর সবচেয়ে ভালো পূর্বাভাসক হলো ৪৪ বছরের বেশি বয়স, পুরুষ লিঙ্গ, এক্স-রেতে হানিকম্বিং এবং ফুসফুসের বায়োপসিতে ফাইব্রোসিসের তীব্রতা । তবে দীর্ঘস্থায়ী পিজিয়ন ব্রিডার্স লাং (CPBL) রোগীদের মৃত্যুহার ইউজুয়াল ইন্টারস্টিশিয়াল নিউমোনিয়া (UIP) রোগীদের তুলনায় কম ।

সচেতনতা ও সমাজের ভূমিকা

ভারতে কবুতর পালন এবং খাওয়ানো একটি সাধারণ অভ্যাস এবং ধর্মীয় রীতির অংশ। তবে এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম । সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ এবং হাসপাতাল থেকে এই বিষয়ে জনসচেতনতা প্রচার প্রয়োজন । মুম্বাইয়ের KEM হাসপাতালের পালমোনারি মেডিসিনের প্রধান একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির সুপারিশ করেছেন যা কবুতর নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে অন্যান্য পরিবেশগত কারণও বিবেচনা করে । শুধু কবুতর নয়, এয়ার কন্ডিশনারের দূষণ, জলের ক্ষতি এবং ছত্রাকের বৃদ্ধিও HP এর কারণ হতে পারে ।

কবুতর পালন বা সংস্পর্শে থাকা একটি নীরব স্বাস্থ্য ঝুঁকি যা হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস এবং অন্যান্য গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের রোগের কারণ হতে পারে। ভারতে এই রোগের প্রকোপ বিশ্বের সর্বোচ্চ, যেখানে ILD রোগীদের ৪৭.৩% HP তে আক্রান্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং কবুতরের সংস্পর্শ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে যা অপরিবর্তনীয়। তাই কবুতর পালনকারী এবং সংস্পর্শে আসেন এমন ব্যক্তিদের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং যেকোনো শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এই রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

আরও পড়ুন