প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিম এশিয়ায় সাম্প্রতিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে একটি জরুরি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠকের আয়োজন করেছেন। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটির এই বৈঠকে পশ্চিম এশিয়ার সংকট এবং এর ফলে বাণিজ্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের সরবরাহের উপর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিম এশিয়ায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিগ্রহ এবং ইরানের ইসরায়েলের উপর ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলার পর পরিস্থিতির তীব্র অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এই জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।
কমিটি পশ্চিম এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে “গভীর উদ্বেগজনক” বলে বর্ণনা করেছে। বৈঠকে চলমান ও ব্যাপক হয়ে ওঠা সংকট থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য, নৌ-পরিবহন এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর এর প্রভাব – বিশেষত তেল, পেট্রোলিয়াম ও এর উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহের উপর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভারত সংঘাতের সকল পক্ষকে সমস্ত ইস্যু দ্রুত সমাধানের জন্য কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। নয়াদিল্লি এও বলেছে যে চলমান সংঘাত যেন “আঞ্চলিকভাবে আরও বিস্তৃত না হয়”।
চাকরি প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে পশ্চিমবঙ্গ: অপেক্ষায় বেকার যুবসমাজ
বৈদেশিক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারত পশ্চিম এশিয়ার সংকট পরিস্থিতি “নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ” করছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে কার্নেগি এনডাউমেন্টে বক্তৃতাকালে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যোগাযোগ সুবিধা প্রদানে ভারত ভূমিকা রাখতে পারে।
জয়শঙ্কর এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে “সন্ত্রাসী হামলা” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোনো দেশের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বিবেচনা করা উচিত এবং বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ক্ষতি বা পরিণতি কমাতে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তিনি অঞ্চলে চলমান সংকট মোকাবেলায় এই নীতিগুলো মেনে চলার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ইরানে ভারতীয় দূতাবাস ভারতীয় নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে, যেখানে “সকল অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ” এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।পশ্চিম এশিয়ার সংকট শুধু যুদ্ধরত দেশগুলোকেই প্রভাবিত করছে না, এর প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপর।
প্রধানমন্ত্রী কিষান মানধন যোজনা: মাসে ৫৫ টাকা জমা করে ৬০ বছর বয়সে পাবেন
বিশেষ করে ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ এই অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত।লাল সাগর ও সুয়েজ খাল রুট ভারতের রপ্তানির ৫০% (১৮ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের) এবং আমদানির ৩০% (১৭ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের) পরিবহন করে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট পণ্য বাণিজ্য (রপ্তানি ও আমদানি একত্রে) ছিল ৯৪ লক্ষ কোটি টাকা, যার ৬৮% (মূল্যের দিক থেকে) এবং ৯৫% (পরিমাণের দিক থেকে) সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়।
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC) দেশগুলোর সাথেও ভারতের ব্যাপক বাণিজ্য রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, GCC এখন ভারতের মোট বাণিজ্যের ১৫% অবদান রাখে এবং শক্তি, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে এই অঞ্চলে দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছে। গত বছর ভারত ও GCC দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৬২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
সুতরাং, পশ্চিম এশিয়ার এই সংকট ভারতের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি এই জরুরি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক আহ্বান করেছেন।এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) জানিয়েছে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরের অর্থনীতিতে বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে। IMF-এর তথ্য অনুযায়য়, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে গাজার জিডিপি ৮৬% কমে গেছে। গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠী এখন চরম আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মানবিক সংকট ও অপর্যাপ্ত সহায়তা সরবরাহের মুখোমুখি।
পশ্চিম তীরেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে সেখানে জিডিপি ২৫% কমেছে বলে প্রাথমিক সরকারি হিসাব জানাচ্ছে।
ইসরায়েলের অর্থনীতিও যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনটি প্রধান রেটিং এজেন্সি ইসরায়েলের ঋণের রেটিং নামিয়েছে। ২০২৩ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ২১% সংকোচনের পর ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ইসরায়েলের জিডিপি ১৪% বেড়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৭% ছিল।
IMF জানিয়েছে, লেবাননেও সাম্প্রতিক সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি দেশটির ইতিমধ্যেই দুর্বল অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে।এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার পশ্চিম এশিয়ার সংকট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক সেই প্রস্তুতিরই অংশ।ভারত সরকার বারবার আহ্বান জানিয়েছে যে, সংঘর্ষরত সকল পক্ষকে আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভারত চায় না যে এই সংঘাত আরও ব্যাপক আঞ্চলিক রূপ নেয়। কারণ তা শুধু পশ্চিম এশিয়া নয়, সারা বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।