প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করতে পারেন। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর এটি হবে তার প্রথম চীন সফর, যা উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথমে ৩০ আগস্ট জাপান সফর করবেন এবং সেখানে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বার্ষিক শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন। এরপর তিনি চীনে গিয়ে এসসিও সম্মেলনে যোগদান করবেন। তবে এই সফরের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।
মোদির এই সফরের তাৎপর্য অনেক বেশি কারণ ২০১৯ সালের পর এটি হবে তার প্রথম চীন সফর। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীনের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্ক চরমভাবে খারাপ হয়ে যায়। সেই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈনিক এবং ৪ জন চীনা সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী মোদি গত বছর অক্টোবরে রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনের পাশে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে।
২০২৫ সালে জনসংখ্যার প্রতিযোগিতায় ভারত বনাম চীন: কে হবে শীর্ষে?
ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে গত কয়েক মাসে বেশ কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। জানুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর পর সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালু করার বিষয়ে সম্মতি হয়েছে। একইসঙ্গে ২০২৫ সালে কৈলাশ মানসরোবর যাত্রা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলছে। তবে ভারতের চীনের সঙ্গে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, যা নিয়ে নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ রয়েছে। চীন তার গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা ভারতের ইলেকট্রনিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এই সফরের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন। এছাড়া রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে আমেরিকা ভারতের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করছে। এই পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি ভারতের জন্য একটি ভারসাম্যের ভূমিকা পালন করতে পারে।
সীমান্ত বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে অগ্রগতিও লক্ষণীয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) বরাবর টহল ব্যবস্থা নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। এর ফলে দেপসাং এবং দেমচোক এলাকায় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনও হাজার হাজার সৈনিক সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েন রয়েছে।
কূটনৈতিক মহলে এই সফরকে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্র এবং চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েইডং-এর মধ্যে বেইজিংয়ে যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রম আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও দুই দেশের মন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। জুনে চীনের কিংডাওতে এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তার চীনা সমকক্ষ ডং জুনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি সীমান্ত বিরোধের স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি কাঠামোবদ্ধ পরিকল্পনার কথা বলেছেন।
তবে সব ক্ষেত্রেই যে অগ্রগতি হয়েছে তা নয়। পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে চীনের অবস্থান নিয়ে ভারতের ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের বিপরীতে যায়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বৃদ্ধিও ভারতের জন্য উদ্বেগজনক।
এসসিও সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদির অংশগ্রহণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। চীন এবারের এসসিও-র সভাপতিত্ব করছে এবং ভারত এর পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্থা, যেখানে রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ সদস্য।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-চীন সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা হল “নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা”। দুই দেশই সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার ব্যয় বুঝতে পারে, কিন্তু মৌলিক বিরোধগুলো এখনও অমীমাংসিত রয়েছে। সীমান্ত বিরোধ, বাণিজ্যিক অসমতা এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতা এখনও দুই দেশের মধ্যে অন্তরায় হয়ে রয়েছে।
ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধের অবসান: ৪ বছর পর টহল চুক্তি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি বলেছেন যে, কাজানে শি-মোদি বৈঠকের পর সম্পর্ক “ইতিবাচক দিকে” এগিয়েছে। তিনি বেইজিংয়ে বলেছেন যে, সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে এবং দুই পক্ষের দায়িত্ব হল এই গতি বজায় রাখা।
নদী সহযোগিতার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হয়েছে। চীন ২০২৫ সালে ব্রহ্মপুত্র এবং সতলজ নদীর বন্যার তথ্য ভাগাভাগি পুনরায় শুরু করেছে। এটি জল কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এদিকে তিব্বতে ইয়ারলুং জাংবো নদীর নিচের দিকে চীনের জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন ভারতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই বাঁধ থেকে বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে জানানো হয়েছে, যা চীনের বিশাল থ্রি গর্জেস বাঁধের তিনগুণ ক্ষমতা।
মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। গণমাধ্যম এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধি, সাংবাদিকদের যাতায়াত সহজীকরণ এবং কৈলাশ মানসরোবর যাত্রা পুনরায় চালুর মতো বিষয়গুলো দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতিতে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্যই নয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। তবে এর জন্য দুই পক্ষের পারস্পরিক আস্থা এবং সহযোগিতার মনোভাব প্রয়োজন, যা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি।