শুক্রবার দুপুর ২টো ১০ মিনিটে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন খ্যাতনামা কবি ও সাংবাদিক রাহুল পুরকায়স্থ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি এবং বেশ কয়েকদিন যাবৃত হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়ার ফলে এদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাংলা কবিতার এই উজ্জ্বল নক্ষত্র।
হাসপাতালে শেষ লড়াই
চিকিৎসকদের মতে, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাহুল পুরকায়স্থকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রথমদিকে চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন তিনি। এমনকি তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বার করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু গত ২২ জুলাই ভোর থেকে হঠাৎ করেই শরীরের অবস্থা খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসকরা তাঁকে আবার ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
গত দুদিন আগে পালস ওঠানামা করছিল, পরিস্থিতি অস্থির হয়ে পড়েছিল। একটি ইনজেকশনে সাময়িক স্থিতি এলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অবশেষে শুক্রবার দুপুরে প্রিয়জনদের উপস্থিতিতে শেষবারের মতো চোখ বুজলেন এই কবি।
বেলঘরিয়ার উদ্বাস্তু কলোনি থেকে কবিতার জগতে
ষাটের দশকে বেলঘরিয়ার যতীন দাস নগর উদ্বাস্তু কলোনিতে জন্ম নেওয়া রাহুল পুরকায়স্থের বেড়ে ওঠা উত্তাল সত্তরের দশকে। পৈতৃক ভিটে শ্রীহট্ট হলেও আশৈশব বেলঘরিয়ার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। শহরতলির সংগ্রামী জীবনে অভ্যস্ত এই তরুণ নকশালদের আগুন ঝরানো দিনে, কলোনির সংগ্রামী রোজনামচায় বড় হয়ে উঠে হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্ষুরধার কলম।
কলোনি জীবনের এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাঁর কবিতায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছিল কলোনির সংগ্রামী মানুষের জীবনচিত্র, প্রেমের প্রকৃতি, সাতের দশকের জীবনচর্যা এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাঁর ‘কলোনির কবিতা’।
সাহিত্যিক জীবনের শুরুয়াত
অল্প বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন রাহুল পুরকায়স্থ। আশির দশক থেকে নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার, প্রিয় স্বরলিপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। এরপর একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলা কবিতার জগতে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
সারা জীবনে প্রায় কুড়িটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘শ্বাসাঘাত তাঁতকল পুরনো হরফ’, ‘একটি জটিল আয়ুরেখা’, ‘গোরস্থান রোড’, ‘আমার সামাজিক ভূমিকা’, ‘নেশা এক প্রিয় ফল’, ‘ও তরঙ্গ লাফাও’, ‘সামান্য এলিজি’। তাঁর বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ও হিন্দিতে দেশ ও বিদেশে।
সাংবাদিকতায় অবদান
কবিতার পাশাপাশি পেশায় ছিলেন গণমাধ্যমের কর্মী। পেশাদার সাংবাদিকতার শুরু ‘আলোকপাত’ পত্রিকার মাধ্যমে। এরপর দূরদর্শন দর্পণ, খাস খবর এবং সবশেষে TV9 বাংলায় কনসাল্টিং এডিটর (প্রোগ্রামিং) হিসেবে কাজ করেছেন। কর্মজীবনে একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
কবিতা এবং সাংবাদিকতা—এই দুই ধারাকে সমান দখলে রেখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। শব্দ আর শিরোনামের জগতে ছিল তাঁর নিঃশব্দ অথচ গভীর আধিপত্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাহুল পুরকায়স্থ পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্মাননা। এছাড়াও পেয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্মান, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্মান, ভাষানগর সম্মান। লেখনীগুণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন।
গত পয়লা বৈশাখে তাঁর হাতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ঐহিক সম্মাননা প্রাপক ভারত-বাংলাদেশের সাত সাহিত্যিকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাহুল পুরকায়স্থ। পেয়েছেন গৌতম বসু সম্মাননাও।
কাব্যিক দর্শন ও প্রভাব
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব ছিল রাহুল পুরকায়স্থের কবিতায়। পাঠকমহলে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরেই উচ্চারিত হতো রাহুল পুরকায়স্থের নাম। শঙ্খ ঘোষ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘আগুন হাতে প্রেমের গান’ সেই দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন রাহুল। তাঁর মতে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এমনকি প্রত্যেক কবি-শিল্পীও সারাজীবন আগুন হাতে প্রেমের গান গেয়েই চলেন।
তাঁর কবিতায় উঠে এসেছিল প্রান্তিক মানুষের কথা। বাঙালিরা তাঁর চোখে ছিল মহাকাব্যের সন্তান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রেম, প্রতিবাদ ও মৃত্যু ছাড়া ইহজীবনে কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। ময়দান ও পানশালার আলো-আঁধারিতে তিনি চেনাতেন গোর্কির নীচের তলাকে।
সমসাময়িক সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট
রাহুল পুরকায়স্থ শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতায় সত্তরের দশকের জীবন্ত দলিল পাওয়া যায় ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা’র মতো রচনায়। শব্দের আলোয় তিনি চেনালেন ‘অন্ধকার’কে এবং প্রিয় স্বরলিপিতে বেঁধেছেন প্রিয়জনদের।
তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ভূমেন্দ্র গুহর কবিতা সংগ্রহ। দেশ-বিদেশের সাহিত্য ও চিত্রকলায় তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন এবং তরুণ কবিদের উৎসাহ দিতেন।
সাহিত্যিক উত্তরাধিকার
রাহুল পুরকায়স্থের প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য হারালো এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর নিজস্ব বীক্ষায় তিনি অনুভব করেছিলেন ‘এইরূপে ক্রমে ক্রমে কবিতা মৃত্যুর দিকে যায়’। কিন্তু যেমনটি তিনি নিজেই বিশ্বাস করতেন, মৃত্যু কখনও গ্রাস করতে পারে না কবিতাকে। রাহুল পুরকায়স্থের শারীরিক মৃত্যুর পরও তাই তাঁর কবিতারা রয়ে গেল ভাবীকালের জন্য—’শ্রুতি ও স্মৃতির মাঝে’।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
সমসাময়িক সময়ে সোশাল মিডিয়ার যুগে কবিতার অবস্থান নিয়ে রাহুল পুরকায়স্থের ছিল স্পষ্ট মতামত। তিনি মনে করতেন সোশাল মিডিয়া কবিতার জন্য একটি ক্ষতিকারক জায়গা, যেখানে তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পেতে গুণগত মান বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে নিয়মিত লাইকে দ্রব্যগুণ নষ্ট হয়।
কবিতার বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তিনি লক্ষ করেছিলেন যে এটি অত্যন্ত অলাভজনক, কেউ পয়সা দিয়ে করেন কেউ করেন না। বর্তমান সময়ে এমনকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রতিষ্ঠিত কবির বইও বিক্রি হয় না—এই বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তাঁর লেখায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘এ-শহরে প্রেম আসে/ উল্কাপাত হয়/ প্রতিটি সন্ধ্যাই জানি/ বিগ্রহের রতিচ্যুত ক্ষয়’। সেই প্রেম, সেই উল্কাপাতের ক্ষিপ্রতা ছেড়ে বিদায় নিলেন এই কবি। রেখে গেলেন তাঁর অক্ষর, যা রয়ে গেল শিল্পের মায়ামেঘে ভাসমান।
চূড়ান্ত বিচারে, রাহুল পুরকায়স্থের প্রস্থান শুধু একজন কবির মৃত্যু নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি। কলোনির সংগ্রামী জীবন থেকে উঠে এসে যিনি বাংলা কবিতায় নিজস্ব অভিজ্ঞান রচনা করেছিলেন, তাঁর চলে যাওয়ায় শূন্য হয়ে গেল এক অনন্য কণ্ঠস্বর। তবে তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আগামী প্রজন্মের হৃদয়ে।