পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। কিন্তু এবার পুজো মণ্ডপে মানুষের শিরদাঁড়া বা মেরুদণ্ডের প্রতীক প্রদর্শন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এধরনের প্রদর্শনীতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করছে এবং পুজো কমিটিগুলোকে তলব করা হচ্ছে। এর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
সম্প্রতি কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে অনেক পুজো কমিটি মানুষের মেরুদণ্ডের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন খবর আসছে যে পুলিশ এসব কমিটিগুলোকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
কুমারটুলির মৃৎশিল্পী সুব্রত পাল জানিয়েছেন, “অনেক পুজো কমিটি আমাদের কাছে মানুষের মেরুদণ্ডের মডেল তৈরির অর্ডার দিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা বলেছে যে পুলিশের চাপে তারা এই সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছে।”
উত্তর কলকাতার একটি বড় পুজো কমিটির সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী বলেছেন, “আমরা মেরুদণ্ডের প্রতীক দিয়ে একটা থিম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্থানীয় থানা থেকে আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বলা হয়েছে যে এটা রাজনৈতিক উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা হতে পারে।”
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “এসব মিথ্যা প্রচার। পুজোকে রাজনীতির উপরে রাখতে হবে। কেউ যদি আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তবেই পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।”
বিজেপি নেতা সমিক ভট্টাচার্য বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনগণের মেরুদণ্ড দেখে ভয় পেয়ে গেছেন। তাই এভাবে দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন।”
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অধ্যাপক অম্বরীশ মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “দুর্গাপুজো বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এটাকে কোনভাবেই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা প্রকাশের অধিকার থাকা উচিত।”
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৩,০০০ সার্বজনীন দুর্গাপুজো হয়, যার মধ্যে কলকাতায় প্রায় ৩,০০০। এর মধ্যে অন্তত ২০টি বড় পুজো কমিটি মেরুদণ্ডের প্রতীক প্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা গেছে।
এই ঘটনার প্রভাব দুদিকে দেখা যাচ্ছে। একদিকে অনেকে মনে করছেন যে সরকার জনগণের অভিব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করছে। অন্যদিকে কিছু মহল বলছেন, পুজোকে রাজনীতিমুক্ত রাখাই উচিত।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. সুদীপ্ত কর মন্তব্য করেছেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের প্রতিবাদের অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মীয় উৎসবকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা থেকেও বিরত থাকা প্রয়োজন।”
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জয়া মিত্র বলেছেন, “দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে সামাজিক বার্তা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তা যেন কোনভাবেই উস্কানিমূলক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা সব পক্ষকে অনুরোধ করছি যেন পুজোর সময় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। যেকোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আগে থেকেই আলোচনা করে নেওয়া ভালো।”
অনেক পুজো কমিটি এখন বিকল্প উপায় খুঁজছে। কেউ কেউ মেরুদণ্ডের পরিবর্তে অন্য প্রতীক ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। আবার কেউ কেউ এই ইস্যু নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছেন।
“মাটি নয়, বিচার চাই”: সোনাগাছির যৌনকর্মীদের অভিনব প্রতিবাদ আরজি কর কাণ্ডে
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা নিয়ে রাজ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সরকার এভাবে হস্তক্ষেপ করে ভুল করছে। আবার অনেকে বলছেন, পুজোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখাই উচিত। তবে এই বিতর্ক যেন পুজোর আনন্দকে ম্লান না করে সেদিকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে পুজো কমিটিগুলো এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে। তারা একদিকে সরকারের রোষানলে পড়তে চাইছে না, অন্যদিকে জনমতকেও উপেক্ষা করতে পারছে না। অনেকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সূক্ষ্মভাবে বার্তা দেওয়ার কথা ভাবছেন।
পুরো ঘটনা প্রমাণ করছে যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি ও সংস্কৃতি কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্গাপুজোর মতো একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে পারে। এটা প্রমাণ করে যে বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতি কতটা জটিল ও বহুমাত্রিক।
তবে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সংযম বজায় রাখা। সরকার, রাজনৈতিক দল, পুজো কমিটি ও সাধারণ মানুষ – সবাইকে বুঝতে হবে যে দুর্গাপুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত যে গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন, কিন্তু সেই সঙ্গে সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যায়, সব পক্ষ এই বিষয়টি বুঝবে এবং আগামী দিনে এমন পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করবে।