‘ডান্স বাংলা ডান্স’—জি বাংলার জনপ্রিয় এই রিয়েলিটি শো-এর মঞ্চে এক অসাধারণ প্রতিভার আগমন ঘটেছে। ব্যারাকপুরের পূজা হালদার, যিনি শুনতে ও কথা বলতে পারেন না, তাঁর অবিশ্বাস্য নৃত্য দিয়ে দর্শক ও বিচারকদের মন জয় করে নিয়েছেন। তাঁর পারফরম্যান্স দেখে কারোরই বোঝার উপায় নেই যে এই তরুণী মূক ও বধির। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে—গান শুনতে না পেলেও কীভাবে তিনি এত নিখুঁতভাবে নাচেন? আর কার কাছে নাচ শিখে তিনি এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন? এই সংবাদে আমরা পূজার এই অসাধারণ যাত্রার গল্প তুলে ধরব।
গত ৯ মার্চ, ২০২৫-এ ‘ডান্স বাংলা ডান্স’-এর গ্র্যান্ড অডিশন পর্বে পূজা হালদার মঞ্চে উঠেছিলেন। তাঁর নাচ দেখে দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে যান বিচারকরাও। মহাগুরু মিঠুন চক্রবর্তী তাঁর আইকনিক কমপ্লিমেন্ট ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ বলে পূজার প্রশংসা করেন। এমনকি তিনি প্রথম ফুলও পান মিঠুনের হাত থেকে। কিন্তু পারফরম্যান্স শেষে যখন পূজা ইশারায় বিচারকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন, তখনই মঞ্চে আসেন তাঁর মা। তিনি জানান, পূজা শুনতে ও কথা বলতে পারেন না। এই তথ্য শুনে বিচারক যিশু সেনগুপ্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, “শুনতে না পেলে বিটে কীভাবে নাচল?” পূজার মা জানান, ছোটবেলা থেকেই পূজা সঙ্গীতের হালকা বিট অনুভব করতে পারেন, আর সেই অনুভূতি দিয়েই তিনি নাচেন। এই ঘটনা পূজাকে দর্শকদের কাছে আরো প্রিয় করে তুলেছে।
পূজার জীবনের গল্পটা কিন্তু সহজ নয়। জন্মের পর থেকেই তিনি মূক ও বধির। তাঁর বাবা এই কারণে তাঁকে ও তাঁর মাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। একা হাতে পূজাকে বড় করেছেন তাঁর মা। কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও পূজার নাচের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি। তিনি ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর মা জানিয়েছেন, পূজা টিভিতে নাচের অনুষ্ঠান দেখে দেখে নিজেই নাচ শিখতে শুরু করেন। পরে তিনি স্থানীয় একটি নৃত্যশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। যদিও তাঁর শিক্ষকের নাম স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি, তবে জানা গেছে, ব্যারাকপুরের একজন নৃত্যশিক্ষক পূজার প্রতিভা দেখে তাঁকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এই শিক্ষকই পূজাকে সঙ্গীতের তাল ছাড়াই শরীরের ছন্দে নাচতে শিখিয়েছেন।
নাচের প্রতি পূজার এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তিনি যে শুধু নাচেন তাই নয়, তাঁর প্রতিটি পারফরম্যান্সে একটা গভীর আবেগ ফুটে ওঠে। ‘ডান্স বাংলা ডান্স’-এর মঞ্চে তিনি মূল পর্বের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। লেডি লায়ন্স এবং ডিএসআর গ্রুপের হয়ে তাঁকে পারফর্ম করতে দেখা যাবে। বিচারক কৌশানি মুখোপাধ্যায়ও পূজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বলেন, “পূজার নাচে যে শক্তি আর আবেগ আছে, তা সত্যিই বিরল।” এই শো-এর নতুন সিজন শুরু হয়েছে গত শনিবার থেকে, এবং পূজার এই পারফরম্যান্স ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে।
একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, পূজার এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে তাঁর মায়ের অক্লান্ত সমর্থন। তিনি শুধু পূজাকে বড় করেননি, তাঁর স্বপ্নকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। পূজার মা বলেন, “ওর নাচ দেখে আমি বুঝেছিলাম, এটাই ওর জীবন। আমি চেয়েছিলাম ও নিজের পায়ে দাঁড়াক।” পূজার এই গল্প প্রমাণ করে যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনো স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও একটা উদাহরণ হয়ে উঠেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূজার মতো ব্যক্তিরা সঙ্গীতের কম্পন বা বিট শরীরের মাধ্যমে অনুভব করতে পারেন। এটি একটি বিশেষ ক্ষমতা, যা সবার থাকে না। পূজা এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নাচের জগতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর এই যাত্রা শুধু ‘ডান্স বাংলা ডান্স’-এর মঞ্চেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি অনেকের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। তাঁর গল্প এখন সবার মুখে মুখে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, পূজা হালদার এক জীবন্ত উদাহরণ যে ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব সম্ভব। তিনি শুনতে না পেলেও, তাঁর নাচে যে সুর বাজে, তা সবাইকে ছুঁয়ে যায়। ব্যারাকপুরের এই কন্যা এখন শুধু নিজের শহরের নয়, গোটা বাংলার গর্ব। তাঁর পরবর্তী পারফরম্যান্সের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে দর্শকরা। পূজার এই গল্প আমাদের শেখায়—জীবনে বাধা থাকলেও, স্বপ্নের পিছনে ছুটলে সাফল্য নিশ্চিত।