যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এবার পুলিশ আউটপোস্ট তৈরির প্রস্তাব উঠে এসেছে। সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এই চিঠিতে ক্যাম্পাসের ভেতরে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের জন্য জায়গা চাওয়া হয়েছে। লালবাজারের দাবি, এই পদক্ষেপ নজরদারি বাড়াতে এবং ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করবে। তবে এই প্রস্তাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে।
গত কয়েক মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক অশান্তির ঘটনা ঘটেছে, যা এই প্রস্তাবের পেছনে মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে গত ১ মার্চ, ২০২৫-এ তৃণমূল সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপার একটি সম্মেলনের সময় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। সেদিন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। “গো ব্যাক” স্লোগানের মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িতে হামলা এবং তাঁর আহত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এর পাশাপাশি, একই রাতে তৃণমূল সমর্থিত কর্মী সংগঠন ‘শিক্ষাবন্ধু’র ক্যাম্পাসের অফিসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর পুলিশ দুজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং মোট সাতটি এফআইআর দায়ের হয়। এই অশান্তির পর থেকেই ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এর আগেও যাদবপুরে বিভিন্ন সময়ে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে র্যাগিংয়ের জেরে এক প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুতে গোটা দেশে আলোড়ন পড়ে। তদন্তে উঠে আসে, হস্টেলে র্যাগিংয়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। এছাড়া, গত ডিসেম্বরে এক মাদকাসক্ত প্রাক্তনীর হস্টেলে তাণ্ডবের ঘটনায় ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। এসব ঘটনার পর ক্যাম্পাসে সিসিটিভি বসানোর প্রস্তাব এলেও, ছাত্রদের একাংশ তাতে বিরোধিতা করে। এবার পুলিশ আউটপোস্টের প্রস্তাবে একইভাবে বিতর্কের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। লালবাজারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে দেশবিরোধী শক্তির উত্থান রোধ এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখাই তাদের লক্ষ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পুলিশের প্রবেশ সবসময়ই বিতর্কিত বিষয়। ২০১৪ সালে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সময় পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে লাঠিচার্জ করেছিল, যা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষেরই থাকে। তবে লালবাজারের মতে, বারবার অশান্তির কারণে এবার ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমরা চিঠি পেয়েছি। এখন সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” এদিকে, এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছেন, “সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি বজায় রাখতে চায়। এটা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করার চক্রান্ত।”
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টও মন্তব্য করেছে যে, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আদালত রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে, যা ১২ মার্চ শুনানিতে জমা পড়বে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ আউটপোস্টের প্রস্তাব নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটি ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাড়াতে পারে। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এতে শিক্ষার স্বাধীন পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যাদবপুরের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এখনও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, বারবার অশান্তির জন্য কঠোর পদক্ষেপ দরকার। অন্যদিকে, অনেকে এটাকে শিক্ষার স্বায়ত্তশাসনের উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন। আপাতত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় সবাই। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে, যাদবপুরের ইতিহাসে এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।