গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র হল নির্বাচন। কিন্তু যখন নির্বাচনের পর হিংসা ছড়িয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের পর যে ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং তাদের দায়িত্বশীলতার অভাব স্পষ্টভাবে প্রকট হয়েছে।
নির্বাচন পরবর্তী হিংসার স্বরূপ:
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় হিংসাত্মক ঘটনা শুরু হয়। বিরোধী দলের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এমনকি মহিলা ও শিশুরাও এই হিংসার শিকার হয়েছেন। অনেক মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা:
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। শাসক দল যেখানে হিংসা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বিরোধী দলগুলোও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। বরং, পরস্পরকে দোষারোপ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। কেউই নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের শান্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে, সাধারণ মানুষ হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা:
পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত ও কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এই ব্যর্থতার পেছনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের বিচারের দাবি উঠেছে সর্বমহলে।
গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব:
নির্বাচন পরবর্তী এই হিংসা শুধু যে কয়েকটি দিনের জন্য শান্তি ভঙ্গ করেছে তা নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে রাজ্যের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর। মানুষের মধ্যে ভীতি ও অনিশ্চয়তা বাড়বে, যা ভবিষ্যৎ নির্বাচনে অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া বিনিয়োগকারীরাও এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করবেন, যার ফলে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন:
নির্বাচন পরবর্তী হিংসায় বহু মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, চলাফেরার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকারসহ নানা ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।
সুশীল সমাজের ভূমিকা:
এই পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের একাংশ স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু অনেকেই নীরব থেকেছেন। অথচ এ সময়ে তাদের সোচ্চার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জরুরি।
সমাধানের পথ:
নির্বাচন পরবর্তী হিংসা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সকল পক্ষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। প্রথমত, সব রাজনৈতিক দলকে এই হিংসার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। তাদের নিজ নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। যারাই অপরাধী হোক না কেন, তাদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। পঞ্চমত, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে জনমত গঠনে সহায়তা করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পরবর্তী হিংসা দেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করেছে। এর জন্য কোনো একক ব্যক্তি বা দলকে দায়ী করা যাবে না, বরং এটি আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতিগত সঙ্কটকেই তুলে ধরেছে। রাজনৈতিক মতভেদ থাকবে, কিন্তু তা কখনোই হিংসার পর্যায়ে যাওয়া উচিত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। সেই ঐক্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সহিষ্ণুতা, সংযম ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
অতীতে বাংলা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানবতাবোধের জন্য বিশ্বের দরবারে সম্মানিত হয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে। কারণ, শেষ পর্যন্ত রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণ, তার ধ্বংস নয়।
নির্বাচন পরবর্তী এই হিংসা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মতভেদ থাকবে কিন্তু মনভেদ থাকবে না। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কিন্তু শত্রুতা নয়। তবেই পশ্চিমবঙ্গ আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে, একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।