ভারতের ডাকসেবায় একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা সারাদেশে একাধিক পোস্ট অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ৫০ বছরের পুরনো রেজিস্টার্ড পোস্ট সেবাও বিলুপ্ত হচ্ছে। গত জুলাইয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা অঞ্চলেই বন্ধ হয়েছে ১৯টি ডাকঘর, আর আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী রেজিস্টার্ড পোস্ট সেবা স্পিড পোস্টের সাথে একীভূত হয়ে যাচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে কলকাতায় ১৫টি ডাকঘর বন্ধ করার প্রস্তাব থাকলেও বাস্তবে ১৯টি ডাকঘর বন্ধ করা হয়েছে। এই বন্ধ হওয়া ডাকঘরগুলির মধ্যে রয়েছে রানি পার্ক, ব্যারাকপুর বাজার, নয়াপল্লি, বেলঘরিয়া পূর্ব, ব্রহ্মস্থান, বিবেকানন্দ মঠ, পার্ক সার্কাস, ঝাউতলা, তিলজলা বাজার, ওয়াটগঞ্জ, জোড়ামন্দির, বোসপুকুর রোড, কেসি মিলস, সোনাই, তারাতলা রোড, রাজাবাগান, কাস্টম হাউজ, পোলক স্ট্রিট এবং পোস্টাল স্টোর্স ডিপো।
ডাক বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সেবার মান উন্নত করা এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি করা। কম ব্যবসা এবং তুলনায় কম গ্রাহকবিশিষ্ট ছোট ডাকঘরগুলিকে কাছের বড় ডাকঘরের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক গ্রাহককে এখন তাদের বাড়ি থেকে দূরের ডাকঘরে যেতে হবে।
ইতিমধ্যেই হাওড়া অঞ্চলেও ৯টি ডাকঘর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সার্কলের চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেলের দফতর থেকে গত ১৮ জুলাই কলকাতা অঞ্চলের পোস্টমাস্টার জেনারেলকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। যদিও দ্রুত প্রক্রিয়াটি সারার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে, রেজিস্টার্ড পোস্ট সেবার ক্ষেত্রেও একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৫০ বছরের পুরনো এই সেবা স্পিড পোস্টের সাথে একীভূত হয়ে যাবে। এর ফলে রেজিস্টার্ড পোস্টের স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে যাবে এবং সব ধরনের নিরাপদ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাঠানোর জন্য স্পিড পোস্ট ব্যবহার করতে হবে।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে রেজিস্টার্ড পোস্টের মাধ্যমে ২৪৪.৪ মিলিয়ন চিঠি পাঠানো হতো, যা ২০১৯-২০ সালে কমে ১৮৪.৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস। ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার, ই-মেইলের ব্যাপক ব্যবহার এবং বেসরকারি কুরিয়ার সংস্থাগুলির প্রতিযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী ডাক সেবার চাহিদা কমে যাওয়াই এর মূল কারণ।
তবে এই একীভূতকরণের ফলে সেবার খরচ বৃদ্ধি পাবে। রেজিস্টার্ড পোস্টের মূল্য ছিল ২৫.৯৬ টাকা এবং প্রতি অতিরিক্ত ২০ গ্রামের জন্য ৫ টাকা। অন্যদিকে স্পিড পোস্টের মূল্য ৫০ গ্রাম পর্যন্ত ৪১ টাকা থেকে শুরু হয়। এতে খরচ ২০-২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে, যা গ্রামাঞ্চলের মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী এবং কৃষকদের উপর প্রভাব ফেলবে।
এই পরিবর্তনের পাশাপাশি ডাক বিভাগ আধুনিকীকরণের আরেকটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। ৫,৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অ্যাডভান্সড পোস্টাল টেকনোলজি (এপিটি) চালু করা হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থা সারাদেশের ১.৬৫ লক্ষ পোস্ট অফিসে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সার্কলে এই নতুন ব্যবস্থা গত জুলাই এবং আগস্ট মাসে পর্যায়ক্রমে চালু হয়েছে।
নতুন এপিটি সিস্টেমে রয়েছে রিয়েল টাইম ট্র্যাকিং, ইউপিআই পেমেন্ট সুবিধা, ওটিপি ভিত্তিক ডেলিভারি এবং ডিজিপিন সেবা। এই ব্যবস্থার ফলে গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে তাদের পার্সেল ট্র্যাক করতে পারবেন এবং অধিক দ্রুততার সাথে সেবা পাবেন। শুধুমাত্র ৫ আগস্ট একদিনেই নতুন সিস্টেমে ২০ লক্ষ পার্সেল বুকিং এবং ২৫ লক্ষ পার্সেল ডেলিভারি হয়েছে।
যদিও ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ডাকঘর একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মী চাকরি হারাবেন না, তবুই গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষত প্রবীণ নাগরিকদের জন্য দূরের ডাকঘরে যাওয়া কষ্টকর হবে। এছাড়া, বর্তমানেও ডাকঘরে প্রতিটি সেবার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে এবং অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। অতিরিক্ত চাপের ফলে গ্রাহক সেবায় আরও সমস্যা হতে পারে।
রেজিস্টার্ড পোস্ট সেবা বিলুপ্তির ব্যাপারেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এই সেবাটি ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে এবং আইনি বৈধতার জন্য আদালত, ব্যাঙ্ক, সরকারি দপ্তরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। চাকরির অফার লেটার, আইনি নোটিশ এবং সরকারি কাগজপত্র পাঠানোর জন্য এই সেবা অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এবং মধ্যবিত্ত পরিবারে এর ব্যবহার ব্যাপক ছিল।
ডাক বিভাগের সচিব এবং মহাপরিচালক সমস্ত সরকারি দপ্তর, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবহারকারীদের ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই একীভূতকরণের মাধ্যমে ট্র্যাকিং এর নির্ভুলতা, ডেলিভারির গতি এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।
পরিবর্তনের এই ঢেউয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডাক সেবাও নতুন রূপ নিচ্ছে। কলকাতা-দিল্লি সরাসরি রোড ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক চালু করা হয়েছে, যা জম্মু কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং দিল্লিতে পার্সেল পৌঁছাতে সাহায্য করবে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সার্কল তিনটি জাতীয় রুটে কাজ করছে – কলকাতা-গুয়াহাটি, কলকাতা-পাটনা এবং কলকাতা-নাগপুর।
এসব পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতের ডাক সেবাকে বিশ্বমানের লজিস্টিক সংস্থায় রূপান্তরিত করা। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এই উন্নতির সাথে সাথে সাধারণ মানুষের সুবিধা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের দিকেও নজর রাখতে হবে।
আগামী দিনে ভারতের ডাক সেবা কতটা কার্যকর হয় এবং গ্রাহকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, তা নির্ভর করবে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া কতটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তার উপর। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এই নতুন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং সরকারকেও নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো গ্রাহক সেবা থেকে বঞ্চিত না হন।