ক্যানসারের সাথে দুই বছরের দীর্ঘ লড়াই শেষে রবিবার ভোর চারটের সময় মুম্বইয়ের মীরা রোডে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী প্রিয়া মারাঠে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এই হিন্দি ও মারাঠি টেলিভিশনের প্রিয় মুখটি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন। ‘পবিত্র রিশতা’র বর্ষা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি লাভ করেছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
রবিবার বিকেল চারটের সময় সম্পন্ন হয় প্রিয়ার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান। ইন্ডাস্ট্রির অনেক নাম-করা অভিনয়শিল্পী উপস্থিত হয়েছিলেন প্রিয়াকে শেষ বিদায় জানাতে। ‘পবিত্র রিশতা’র সহ-অভিনেত্রী প্রার্থনা বেহেরে প্রিয়ার মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি হাত জোড় করে নীরব প্রার্থনায় মগ্ন হয়েছিলেন, মুখে ছিল গভীর শোকের ছাপ।
অভিনেতা অভিজিৎ খান্ডেকার, শালমালি টোয়লে, অম প্রকাশ শিন্ডে, আস্তাদ কালে এবং সুযশ তিলক সহ আরও অনেক মারাঠি অভিনেতা এই বেদনার মুহূর্তে প্রিয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অভিজিৎ খান্ডেকারকে দেখা যায় প্রিয়ার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে।
প্রিয়ার স্বামী অভিনেতা শান্তনু মোগে এই কঠিন সময়ে একাই মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল বিয়ে হয়েছিল। দুজনে একসাথে কাজ করেছেন ‘স্বরাজ্যরক্ষক সম্ভাজি’ ধারাবাহিকে। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিল তাদের সম্পর্ক।
অকাল প্রয়াণে ‘পবিত্র রিশতা’র বর্ষীয়ান অভিনেত্রী উষা নাদকর্ণি জানান, ‘শুনেছিলাম ওর ক্যানসার হয়েছে। অপারেশন হয়েছিল। এমনকী আবার কাজও শুরু করেছিল। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম ওর শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। ভেবেছিলাম দেখা করতে যাব। কিন্তু ওর স্বামী শান্তনু আমাদের যেতে বারণ করেছেন। হয়তো কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাওয়ায় প্রিয়া কারও সামনে আসতে চাইছিল না।’
প্রিয়া অঙ্কিতা লোখান্ডের বোন বর্ষার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘পবিত্র রিশতা’তে। এই ধারাবাহিকেই তিনি সুশান্ত সিং রাজপুত ও অঙ্কিতা লোখান্ডের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘পবিত্র রিশতা’র অনুরাগ শর্মা, যিনি প্রিয়ার পর্দার স্বামী সতীশের ভূমিকায় ছিলেন, তিনি ইনস্টাগ্রামে আবেগঘন পোস্টে লিখেছেন এটি হৃদয়বিদারক সংবাদ। তিনি বলেছেন প্রিয়া ছিলেন প্রিয় বন্ধু ও দক্ষ শিল্পী।
অঙ্কিতা লোখান্ডেও গভীর শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘প্রিয়া ছিল আমার ‘পবিত্র রিশতা’র প্রথম বন্ধু। আমি, প্রার্থনা আর প্রিয়া… আমাদের ছোট্ট দল… যখন আমরা একসাথে থাকতাম সবকিছু অত্যন্ত আনন্দদায়ক মনে হতো।’ তিনি আরও জানান, তিনজনে মারাঠিতে একে অপরকে ‘ওয়েদি’ বলে ডাকতেন, যার মানে বান্ধবী।
১৯৮৭ সালের ২৩ এপ্রিল মুম্বইয়ে জন্মগ্রহণ করেন প্রিয়া মারাঠে। মুম্বইয়েই তার পড়াশোনা সম্পন্ন হয়। পড়াশোনা শেষ করার পরই তিনি অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন। মারাঠি ধারাবাহিক ‘ইয়া সুখানোয়া’ দিয়ে তার অভিনয়ের যাত্রা শুরু। এরপর ‘চার দিবস সাসুছে’র মাধ্যমে মারাঠি টেলিভিশনে তিনি নিজের অবস্থান পাকা করেন।
হিন্দি টেলিভিশনে প্রিয়ার প্রথম কাজ ছিল বালাজি টেলিফিল্মসের ‘কসম সে’ ধারাবাহিকে বিদ্যা বালি চরিত্রে অভিনয়। এটি তার ক্যারিয়ারে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর তিনি ‘কমেডি সার্কাস’-এর প্রথম সিজনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
প্রিয়া প্রথমে মারাঠি ধারাবাহিক দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও হিন্দি টেলিভিশনে তার সবচেয়ে আলোচিত কাজ ‘পবিত্র রিশতা’। এই ধারাবাহিকে তিনি বর্ষা সতীশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীকালে ‘বড়ে আচ্ছে লগতে হ্যায়’-এ জ্যোতি মালহোত্রার চরিত্রেও তাকে দেখা যায়।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘তু তিথে মে’, ‘ভাগে রে মন’, ‘জয়স্তুতে’, ‘ভারত কা বীর পুত্র – মহারানা প্রতাপ’ এবং ‘সাথ নিভানা সাথিয়া’। ২০১৭ সালে ‘সাথ নিভানা সাথিয়া’তে তিনি ভবানী রাঠোর চরিত্রে অভিনয় করেন, যে একজন কুটিল ও খল স্বভাবের নারী।
শুধু টেলিভিশন নয়, থিয়েটার এবং সিনেমায়ও কাজ করেছেন প্রিয়া। ২০০৮ সালে ‘হুমনে জীনা শিখ লিয়া’ হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন। গোবিন্দ নিহালানি পরিচালিত ‘তি আনি ইতার’ মারাঠি ছবিতেও তার অভিনয় দেখা যায়।
গত দুই বছর ধরে ক্যানসারের সাথে সাহসের সাথে লড়াই করছিলেন প্রিয়া। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখালেও পরবর্তীতে রোগটি আবার ফিরে আসে। গত কয়েক মাসে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন প্রিয়া। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট তার শেষ পোস্ট। জয়পুরের আমের ফোর্ট ভ্রমণের সময় স্বামী শান্তনু মোগের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তের ছবি শেয়ার করেছিলেন সেই পোস্টে। এই পোস্টেই এখন ভক্তরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছেন।
প্রিয়ার দ্বিতীয় সর্বশেষ পোস্টে তাকে দেখা যাচ্ছে মহারাষ্ট্রীয় সাজে নৌভারি শাড়ি এবং নাকে নথ পরে। তৃতীয় সর্বশেষ পোস্টটি ছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের একটি মজার রিল।
টেলিভিশন জগতে তার অকাল প্রয়াণ অভিনয়প্রেমীদের হৃদয়ে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মারাঠি এবং হিন্দি উভয় মাধ্যমেই সফলভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। তার বহুমুখী প্রতিভা এবং অভিনয়ে নিষ্ঠা তাকে ইন্ডাস্ট্রিতে একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।
দর্শকদের কাছে প্রিয়ার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র বর্ষা সতীশ ‘পবিত্র রিশতা’ থেকে। এই চরিত্রের মাধ্যমে তিনি ভারতের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার অভিনয়ের গভীরতা এবং সহজাত অভিব্যক্তি দর্শকদের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান হিসেবেও প্রিয়ার দক্ষতা ছিল। ‘কমেডি সার্কাস’-এ তার হাস্যরসের প্রদর্শন দর্শকদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তার প্রতিভা কেবল নাটকীয় ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নেই।
প্রিয়া এবং শান্তনু দম্পতি ইন্ডাস্ট্রির একটি জনপ্রিয় জুটি ছিল। তারা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সবসময়ই গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা কিছু মুহূর্ত তাদের গভীর ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে।
বিনোদন জগতে তার অবদান এবং উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের জন্য প্রিয়া মারাঠেকে সর্বদা স্মরণ করা হবে। তার চলে যাওয়ায় মারাঠি ও হিন্দি উভয় টেলিভিশন জগৎ একজন প্রতিভাবান শিল্পীকে হারিয়েছে। তার স্মৃতি এবং কাজ দর্শকদের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।