গর্ভাবস্থা প্রত্যেক নারীর জীবনে এক অন্যতম সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়। এই সময় শরীরে নানা পরিবর্তন আসে, যার মধ্যে কিছু सुखকর হলেও, কিছু পরিবর্তন বেশ অস্বস্তিকর হতে পারে। এমনই এক সাধারণ অথচ বিরক্তিকর সমস্যা হলো গর্ভাবস্থায় চুলকানি বা pruritus in pregnancy। পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ২৩% গর্ভবতী মহিলাই কমবেশি এই সমস্যার সম্মুখীন হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের অংশ হলেও, কখনও কখনও এটি এক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যা মা এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই, এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা ও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই আর্টিকেলে আমরা গর্ভাবস্থায় চুলকানির কারণ, সাধারণ প্রতিকার এবং কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক, সেই সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন গর্ভাবস্থায় চুলকানি এত সাধারণ?
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীর এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। হরমোনের মাত্রার আকস্মিক পরিবর্তন, ত্বকের প্রসারণ এবং শরীরের বিপাকীয় কার্যকলাপের পরিবর্তনের কারণে ত্বকে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। চুলকানি বা ডাক্তারি ভাষায় pruritus in pregnancy এমনই একটি উপসর্গ। সাধারণত, পেট, স্তন, কোমর এবং ঊরুর চামড়া প্রসারিত হওয়ার কারণে চুলকানি দেখা দেয়। ত্বকের শুষ্কতাও এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে, তীব্র চুলকানি, বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে হলে, তা অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ এটি ‘ইন্ট্রাহেপ্যাটিক কোলেস্টেসিস অফ প্রেগনেন্সি’ (ICP) এর মতো গুরুতর লিভারের রোগের লক্ষণ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় চুলকানির সাধারণ কারণ (Common Causes of Pruritus in Pregnancy)
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থায় চুলকানির কারণগুলো ক্ষতিকর নয়। আসুন জেনে নিই সেই কারণগুলো সম্পর্কে:
১. ত্বকের প্রসারণ (Stretching Skin)
গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে, বিশেষ করে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (third trimester), জরায়ু বড় হওয়ার কারণে পেটের ত্বক প্রসারিত হয়। এই চামড়া ফেটে গিয়ে স্ট্রেচ মার্কস (Stretch Marks) তৈরি হয় এবং এর ফলে তীব্র চুলকানি হতে পারে। একই ঘটনা স্তন এবং নিতম্বের ক্ষেত্রেও ঘটে।
২. হরমোনের পরিবর্তন (Hormonal Changes)
গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেন (Estrogen) এবং অন্যান্য হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো ত্বকের আর্দ্রতা কমিয়ে দিয়ে তাকে শুষ্ক করে তুলতে পারে। শুষ্ক ত্বক চুলকানির অন্যতম প্রধান কারণ।
৩. একজিমা বা অ্যাটোপিক ইরাপশন অফ প্রেগনেন্সি (AEP)
অনেক মহিলার গর্ভাবস্থার আগে থেকেই একজিমার সমস্যা থাকে, যা এই সময় বেড়ে যেতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থায় প্রথমবার একজিমার মতো র্যাশ দেখা দেয়, যাকে অ্যাটোপিক ইরাপশন অফ প্রেগনেন্সি (AEP) বলা হয়। এটি সাধারণত গালের ভাঁজে, ঘাড়ে বা কনুইয়ের সামনের অংশে দেখা যায় এবং এর সাথে তীব্র চুলকানি থাকে।
৪. প্রুরাইটিক আর্টিকেরিয়াল প্যাপুলস অ্যান্ড প্ল্যাকস অফ প্রেগনেন্সি (PUPPP)
এটি গর্ভাবস্থার সবচেয়ে সাধারণ চর্মরোগগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা প্রতি ১৬০ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জনের হয়ে থাকে। PUPPP সাধারণত প্রথম গর্ভাবস্থায় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে দেখা যায়। এতে পেটের স্ট্রেচ মার্কসের চারপাশে ছোট ছোট লাল র্যাশ বা আমবাতের মতো ফোলা দাগ দেখা যায়, যা পরে ঊরু, নিতম্ব এবং হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদিও এটি দেখতে ভয়াবহ এবং অত্যন্ত চুলকোয়, তবে মা বা শিশুর জন্য এটি ক্ষতিকর নয় এবং প্রসবের পর সেরে যায়।
কখন চুলকানি বিপদের লক্ষণ? (When Itching is a Red Flag)
সাধারণ চুলকানির বাইরেও কিছু পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে চুলকানি এক গভীর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এই ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
ইন্ট্রাহেপ্যাটিক কোলেস্টেসিস অফ প্রেগনেন্সি (ICP)
এটি একটি গুরুতর যকৃতের (Liver) রোগ যা গর্ভাবস্থায় দেখা দেয়। এই অবস্থায়, লিভার থেকে পিত্ত (Bile) প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং রক্তে পিত্ত অ্যাসিড (Bile Acids) জমা হতে থাকে। এর প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র চুলকানি, যা সাধারণত কোনো র্যাশ ছাড়াই হয়।
- লক্ষণ:
- হাতের তালু এবং পায়ের পাতায় তীব্র চুলকানি, যা রাতে আরও বেড়ে যায়।
- গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
- ফ্যাকাসে রঙের মল।
- জন্ডিস (চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া)।
- বমি বমি ভাব ও ক্ষুধা কমে যাওয়া।
- ঝুঁকি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, ICP গর্ভস্থ শিশুর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এর ফলে অপরিণত প্রসব (premature birth), ভ্রূণের শ্বাসকষ্ট এবং এমনকি মৃত সন্তান (stillbirth) প্রসবের আশঙ্কা থাকে। বিশ্বজুড়ে এর প্রাদুর্ভাব বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন হলেও, একটি সাম্প্রতিক মেটা-অ্যানালিসিস অনুযায়ী প্রায় ২.৯% গর্ভবতী নারী এতে আক্রান্ত হন।
ICP সন্দেহ হলে চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে লিভার ফাংশন এবং বাইল অ্যাসিডের মাত্রা পরীক্ষা করেন। রোগ নির্ণয় হলে, নির্দিষ্ট ঔষধ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মা ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
ঘরোয়া প্রতিকার ও করণীয়
যদি আপনার চুলকানি সাধারণ কারণগুলোর জন্য হয়ে থাকে, তবে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনে আরাম পেতে পারেন:
- ত্বককে আর্দ্র রাখুন: শুষ্ক ত্বক চুলকানি বাড়ায়। তাই প্রতিদিন ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার, নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন। স্নানের পর ভেজা ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগালে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
- ঠান্ডা সেঁক দিন: চুলকানির জায়গায় ঠান্ডা, ভেজা কাপড় বা বরফ প্যাক দিয়ে সেঁক দিলে সাময়িক আরাম মেলে।
- ওটমিল বাথ: হালকা গরম জলে কলয়েডাল ওটমিল (Colloidal Oatmeal) মিশিয়ে স্নান করলে ত্বকের জ্বালা ও চুলকানি কমে।
- সঠিক পোশাক পরুন: সুতির, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন যা ত্বকে হাওয়া চলাচল করতে সাহায্য করে। সিন্থেটিক কাপড় এড়িয়ে চলুন।
- অতিরিক্ত গরম এড়িয়ে চলুন: গরম জল দিয়ে স্নান এবং অতিরিক্ত ঘাম চুলকানি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- নখ ছোট রাখুন: চুলকানোর প্রবণতা থাকলে নখ ছোট করে কেটে রাখুন, যাতে ত্বকে ক্ষত না হয়।
- প্রচুর জল পান করুন: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখলে ত্বকও সুস্থ থাকে।
বিশেষজ্ঞের মতামত ও চিকিৎসা
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, গর্ভাবস্থায় যেকোনো ত্বকের সমস্যায় নিজে থেকে কোনো ঔষধ বা ক্রিম ব্যবহার করা উচিত নয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) এর মতে, তীব্র চুলকানি হলে অবশ্যই ধাত্রী বা চিকিৎসককে জানানো উচিত।
- সাধারণ চুলকানির চিকিৎসা: চিকিৎসক আপনাকে ক্যালামাইন লোশন (Calamine Lotion) বা মেনথলযুক্ত নিরাপদ ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। প্রয়োজনে, গর্ভাবস্থায় নিরাপদ অ্যান্টিহিস্টামিন (Antihistamine) ঔষধ দেওয়া হতে পারে।
- PUPPP-এর চিকিৎসা: এই ক্ষেত্রে, চুলকানি কমাতে টপিক্যাল কর্টিকোস্টেরয়েড (Topical Corticosteroids) ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
- ICP-এর চিকিৎসা: ICP নির্ণয় হলে, চিকিৎসক আর্সোডিওক্সিকোলিক অ্যাসিড (Ursodeoxycholic Acid – UDCA) নামক ঔষধ দেন, যা রক্তে বাইল অ্যাসিডের মাত্রা কমায় এবং চুলকানি উপশম করে। একই সাথে, গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের উপর কড়া নজর রাখা হয় এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রসব করানো হতে পারে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থায় চুলকানি বা pruritus in pregnancy একটি সাধারণ সমস্যা হলেও একে পুরোপুরি অবহেলা করা ঠিক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি নিরীহ এবং কিছু সাধারণ যত্নেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে, চুলকানি যদি তীব্র হয়, দৈনন্দিন জীবনে বাধা সৃষ্টি করে, বা এর সাথে র্যাশ বা অন্য কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতাই পারে আপনার এবং আপনার অনাগত সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণই হলো নিরাপদ ও সুস্থ গর্ভাবস্থার চাবিকাঠি।
সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ Section)
১. গর্ভাবস্থায় পেটে চুলকানি হওয়া কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় পেট এবং স্তনের চামড়া প্রসারিত হওয়ার কারণে চুলকানি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে এবং ত্বককে আর্দ্র রেখে এটি কমানো যায়।
২. চুলকানি কি গর্ভের শিশুর কোনো ক্ষতি করতে পারে?
সাধারণ চুলকানি, যেমন ত্বকের প্রসারণ বা PUPPP-এর কারণে হলে, তা শিশুর কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু যদি চুলকানি ইন্ট্রাহেপ্যাটিক কোলেস্টেসিস অফ প্রেগনেন্সি (ICP)-এর কারণে হয়, তবে তা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
৩. গর্ভাবস্থায় চুলকানির জন্য কী ক্রিম ব্যবহার করা নিরাপদ?
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ক্রিম বা ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয়। সাধারণত ক্যালামাইন লোশন, অ্যালোভেরা জেল বা মেনথলযুক্ত ময়েশ্চারাইজার নিরাপদ বলে মনে করা হয়। প্রয়োজনে চিকিৎসক আপনাকে গর্ভাবস্থায় নিরাপদ স্টেরয়েড ক্রিম দিতে পারেন।
৪. কখন চুলকানির জন্য ডাক্তার দেখানো উচিত?
যদি চুলকানি খুব তীব্র হয়, বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে হয়, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, বা চুলকানির সাথে জন্ডিসের মতো অন্য কোনো উপসর্গ দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত।
৫. প্রসবের পর কি চুলকানি চলে যায়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, যেমন PUPPP বা ICP-এর কারণে হওয়া চুলকানি, প্রসবের কয়েক দিনের বা সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে চলে যায়।