গত জুলাই মাস থেকে দ্রুত-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো—Blinkit, Swiggy ও Zepto—গ্রাহক নাকি অগোছালো খরচের ফাঁদে ফেলে দিচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রান্না করা খাবার বা প্রয়োজনীয় আবশ্যক সামগ্রী অর্ডার করা হাজার হাজার ব্যবহারকারীই অনিশ্চিত ফি ও সার্ভিস চার্জে অতিরিক্ত অর্থ হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে। কলকাতা, মুম্বই, হায়দ্রাবাদসহ একাধিক শহরে গ্রাহকরা বলছেন, অর্ডার কনফার্ম হওয়ার পর ফোনে মতো জুস্ট ইন টাইম ডেলিভারিতে যে ফি দেখানো হয়েছিল, তা কোন এক অদৃশ্য ট্যাক্স বা প্যাকেজিং চার্জের আড়ালে অনেক দ্বিগুণে উঠে যাচ্ছে।
অফিস প্রাঙ্গণে কাজ শেষে ঝটপট কেনাকাটা করতে গিয়ে সায়াহ্নের আলো ফিকে পড়ে যায়—কারণ অপ্রত্যাশিত “লোকাল ডেলিভারি চার্জ” ও “মিনি অর্ডার ফি” একসঙ্গে যোগ করে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকা সত্ত্বেও পেমেন্ট ব্যর্থ হয়। ব্যবহারকারীর অভিযোগ, অর্ডারের পরিনত বিলের অর্ধেকেরও বেশি অজানা খরচই গোপন চার্জের আওতাভুক্ত। Blinkit–এ প্যাকেটিং চার্জ, Zepto–তে মানি ব্যাক ফান্ডিং ফি, Swiggy–তে ফুল সার্ভিস চার্জ—প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই “ঠিক-ঠাক” ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না ক্রেতারা।
সমস্যাটি শুরু হয় যখন ই–কমার্স দুনিয়ার নিয়মিত অফার ও ডিসকাউন্ট দেখে আকৃষ্ট গ্রাহক অর্ডার দেয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে “এমএমবি (মিনি-মান্ডেটরি বালেন্স) চার্জ”, “ব্র্যান্ড প্রিমিয়াম ফি” ইত্যাদি অজানা নামের ফি যোগ হয়ে অর্ডার ব্যালেন্স আকাশছোঁয়া হয়ে উঠে। গত ১৫ অগাস্ট শহরজুড়ে বিপণি আইন দফতর একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করে, যারা Blinkit, Swiggy ও Zepto–তে অন্তর্নিহিত ফি–র প্রকৃততা পর্যালোচনা করছেন। ইতিমধ্যে রাজ্য ভোক্তা সুরক্ষা ব্যুরো ১২টি ব্যবহারকারীর প্রাথমিক অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে।
এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে দেখে মনে হয় গ্রাহককে প্রথমে ‘ক্যাপচার’ করা হচ্ছে আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট দিয়ে, তারপর ‘ক্যাপচার’ করা হয়েছে গোপন ফি দিয়ে। যেমনই গ্রাহক অ্যাপে গিয়েই পছন্দের ব্র্যান্ডযুক্ত আইটেম সিলেক্ট করেন, অর্ডার কনফার্ম করতে গেলে হঠাৎ জরুরি সার্ভিস চার্জ, ইনসুরেন্স চার্জ, ই—উইন ভেরিফিকেশন ফি ইত্যাদি দেখানো হয়। এসব ফি–র অতিরিক্ত অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে Swiggy–র ‘স্লট বুকিং চার্জ’ ও Zepto–র ‘ফাস্টার ডেলিভারি ফান্ডিং চার্জ’-এর বিরুদ্ধে।
Blinkit পরিচারক সূত্র বলেছে, “আমরা গ্রাহকদের স্বচ্ছতা দিতে প্যাকেটিং ও ডেলিভারি খরচ দেখাই, তবে কিছু শহরে লোকাল পার্টনাররা অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আরোপ করে। তার পুরো দায় আমাদের নয়।” তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ মনে করাচ্ছে, কোনো ট্রানজাকশনে প্রাপ্য ফি–ই হতে পারে, আর গ্রাহক সর্বক্ষণ আগে সেটার পূর্ণ বিবরণ পেতে অগ্রাধিকার বোধ করেন।
গত বছরের তুলনায় দ্রুত-কমার্স সেক্টরে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একইসঙ্গে, ব্যবহারকারীরা অতিরিক্ত ফি ও হিডেন চার্জের কারণে প্রত্যেক অর্ডারে গড়ে ১০০–১৫০ টাকা খরচ বেশি করে দিচ্ছেন বলে একটি স্বাধীন জরিপ অনুমান করেছে। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়েই গ্রাহকরা আরেকবার চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন—তেমনি অনলাইন অর্ডার করবেন কি না।
নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতার অভাবে ভোক্তা বিভ্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকারি কর আদায়েও ভুল তথ্য জমা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। প্রস্তাবিত হচ্ছে, দ্রুত-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে অন্তত অর্ডার প্রক্রিয়াকরণের প্রতিটি ধাপে সার্বিক ফি তালিকা দেখাতে বাধ্য করা হোক।
পাশাপাশি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিকর্তা জানিয়েছেন, “প্রথমেই সমস্ত ফি স্পষ্ট করতে না পারলে, গ্রাহকের অভিযোগ শুনে উপযুক্ত জরিমানা ও প্রতিকার নিশ্চিত করা হবে।” এখন দেখা যাচ্ছে, আগামী মাস থেকেই রাজ্য পর্যায়ে নিরাপত্তা পর্ষদ ও ভোক্তা অধিকরণ দপ্তর একযোগে প্ল্যাটফর্মগুলো পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কার বিলিং ব্যবস্থার জন্য মান নির্ধারণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
সাক্ষ্য হিসেবে জানতে চাওয়া হলে কর্পোরেট সেক্টরের এক বিশ্লেষক বলেন, “কনজিউমার রেজিস্টেশন প্রসেসে গ্রাহক শুধু প্রাথমিক দাম দেখে লোভে পড়ে, এরপর গোপন চার্জের ফাঁদে পা দেয়।” তাই ক্রেতাদের সতর্ক হওয়ার জন্য বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—অর্ডার সাবমিশনের আগে “ডিটেইলড ইনভয়েস ভিউ”–তে দেখুন সব ধরনের চার্জ কী কী, তার পরেই পেমেন্ট নিশ্চিত করুন।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দ্রুত-কমার্স সেক্টর সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রামাণিক বিলিং ও স্বচ্ছ তথ্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি করছে; একইসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও নিয়মিত তদন্ত ও ফি–র মান নির্ধারণে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও টাকায় পূর্ণ মূল্য নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই এই অস্থিরতা দ্রুত কাটিয়ে উঠার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।