কালীপুজোর রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ক্ষোভজনক পোস্টে বলিউডে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপমানের অভিযোগ তুললেন কবি ও পরিচালক শ্রীজাত। তাঁর অভিযোগ, কপিল শর্মার একটি কৌতুক শো-তে অভিনেত্রী কাজল অগরওয়াল রবীন্দ্রনাথের একটি গান নিয়ে অশোভন মন্তব্য করেছেন। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বাংলার শিল্পী মহলে। শ্রীজাত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন, অন্যদিকে সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এই ঘটনার জন্য অশিক্ষাকেই দায়ী করেছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কপিল শো’ নামক একটি কৌতুক অনুষ্ঠানে। অভিযোগ অনুযায়ী, এই অনুষ্ঠানে কাজল অগরওয়াল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান নিয়ে অমর্যাদাকর মন্তব্য করেছেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “কপিল শর্মার শো-তে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যে অপমানজনক মন্তব্য করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির অপমান। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছি।”
RG Kar Doctor Rape-Murder Case: বলিউড তারকাদের প্রতিবাদ: “নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়”
অন্যদিকে, সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এই ঘটনার জন্য অশিক্ষাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, “এটা দুঃখজনক যে আমাদের দেশের একজন মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এভাবে অপমানজনক মন্তব্য করা হচ্ছে। এর পিছনে মূল কারণ হল অশিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে না।”
এই ঘটনা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অবমাননার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা। তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, যা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার। তাঁর লেখা ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীত এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন। এছাড়াও তিনি ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান রচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য হল ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। তাঁর রচনায় ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শনের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজসংস্কারকও। তিনি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলেন।
১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে “পল্লীসংগঠন কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে তিনি এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন “শ্রীনিকেতন”।
পাকিস্তানকে IMF-এর চেয়েও বেশি অর্থ সাহায্য দিতে পারত ভারত – রাজনাথ সিংহের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য
রবীন্দ্রনাথের এই বিশাল অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে, তাঁকে নিয়ে কৌতুক করা বা অপমানজনক মন্তব্য করা অত্যন্ত অশোভনীয় ও দুঃখজনক। এই ধরনের ঘটনা শুধু রবীন্দ্রনাথকে নয়, সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অপমান করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “আমি এই বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। যদি কপিল শর্মা বা তাঁর টিম থেকে কোনও ক্ষমা প্রার্থনা না আসে, তাহলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।”
অন্যদিকে, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের মন্তব্য এই ঘটনার একটি গভীর দিকে আলোকপাত করেছে। তিনি বলেছেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে, অনেকেই তাঁদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখতে পারছে না।”
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঠিক জ্ঞান প্রসার করা জরুরি। এর মাধ্যমে, ভবিষ্যতে এই ধরনের অপমানজনক ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।
এছাড়াও, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার প্রশ্নটিও এখানে উঠে আসে। একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন শো-তে এই ধরনের অপমানজনক মন্তব্য করা হলে, তা লক্ষ লক্ষ দর্শকের কাছে পৌঁছে যায়। তাই, গণমাধ্যমের কর্মীদের অবশ্যই সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।