বলিউডের সাহসী র‍্যাডিক্যাল বর্ণবিরোধী প্রকল্প যা পাল্টে দিচ্ছে সিনেমার ভাষা

Sangita Chowdhury 5 Min Read

Radical Anti-Caste Project Dhadak 2: বলিউডের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে যে কোনো মূলধারার চলচ্চিত্র জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে এত সাহসী অবস্থান নিয়েছে। ২০২৫ সালের ‘ধড়ক ২’ সেই বিরল উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি, যা শুধুমাত্র একটি প্রেমের গল্প নয়, বরং একটি র্যাডিক্যাল বর্ণবিরোধী প্রকল্প হিসেবে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। শাজিয়া ইকবালের পরিচালনায় এই চলচ্চিত্রটি ভারতীয় সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা বর্ণপ্রথার বিষাক্ত শিকড়গুলোকে উন্মোচন করে দিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন বেশিরভাগ বলিউড ছবি এই বিষয়টি এড়িয়ে চলে।

বলিউডের ঐতিহ্যবাহী নীরবতা ভাঙার সাহসী প্রয়াস

দশকের পর দশক ধরে বলিউড জাতিভেদ প্রথার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছে অথবা একে কেবল গ্রামীণ সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু ‘ধড়ক ২’ এই ধারণাটিকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছে। চলচ্চিত্রটি প্রমাণ করেছে যে শহুরে, আধুনিক ভারতেও জাতিভেদ প্রথা শিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যেও গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে।

যশ হতে চলেছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত খলনায়ক।

নীলেশ আহিরওয়ারের চরিত্রে নতুন মাত্রা

সিদ্ধান্ত চতুর্বেদীর অভিনীত নীলেশ আহিরওয়ার কেবল একজন প্রেমিক নয়, বরং সে একজন দলিত আন্দোলনের প্রতীক। তার ঢোল দলের নাম ‘ভীম বাজা ঢোল বয়েজ’ থেকে শুরু করে তার বাসস্থান ‘ভীমনগর’ – সবকিছুতেই ড. ভীমরাও আম্বেদকরের আদর্শের প্রতিফলন দেখা যায়। এটি শুধু একটি নামকরণ নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বক্তব্য

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতিভেদের নগ্ন রূপ

‘ধড়ক ২’-এর অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো এটি দেখিয়েছে কীভাবে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জাতিভেদ বিদ্যমান। যখন শিক্ষার্থীদের পরিচয়ের সময় পদবি উল্লেখ করতে বলা হয়, তখন নীলেশের জন্য এটি হয়ে ওঠে একটি আতঙ্কের মুহূর্ত। কারণ তার পদবিই তার জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করে দেবে।

রোহিত ভেমুলার স্মরণে

চলচ্চিত্রটিতে রোহিত ভেমুলার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, যার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতিভেদের নগ্ন চেহারা তুলে ধরেছিল। শেখর চরিত্রের মাধ্যমে আম্বেদকর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড এবং ছাত্র রাজনীতিতে দলিত চেতনার উত্থান দেখানো হয়েছে।

বিদ্যির চরিত্রে নারী ক্ষমতায়নের নতুন মাত্রা

ত্রিপ্তি ডিমরির অভিনীত বিদ্যি ভারদ্বাজ কেবল একজন উচ্চবর্ণের মেয়ে নয়, বরং সে একজন বর্ণপ্রথা বিরোধী যোদ্ধা। তার চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কীভাবে একজন উচ্চবর্ণের নারী তার পারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।

পারিবারিক কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

বিদ্যির বাবা একজন শিক্ষিত দ্বিতীয় প্রজন্মের আইনজীবী, যিনি নীলেশকে বলেন যে কেবল একসাথে পড়াশোনা করলেই তারা সমান হয়ে যায় না। এই সংলাপের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি দেখিয়েছে কীভাবে আধুনিক শিক্ষিত পরিবারেও জাতিভেদ টিকে থাকে

আম্বেদকরীয় আদর্শের প্রতিফলন

‘ধড়ক ২’ একটি র্যাডিক্যাল বর্ণবিরোধী প্রকল্প হিসেবে আম্বেদকরীয় চিন্তাধারাকে সিনেমার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যেই ‘জয় ভীম’ শ্লোগান দৃশ্যমান, যা দর্শকদের জানান দেয় এটি কেবল একটি প্রেমের গল্প নয়।

দলিত রাজনীতির নতুন ভাষা

নীলেশের চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কীভাবে একজন দলিত যুবক কাঁশী রামের ‘ভাগিদারি রাজনীতি’ এবং ভীম আর্মি প্রধান চন্দ্রশেখরের র্যাডিক্যাল দলিত দৃঢ়তার আদর্শ বহন করে। এটি বলিউডে দলিত চরিত্র উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।

সেন্সরশিপ এবং প্রতিবন্ধকতার মুখে সাহসিকতা

‘ধড়ক ২’ মুক্তির পূর্বে ১৬টি কাটিং এর সম্মুখীন হয়েছিল, যা প্রমাণ করে এর বিষয়বস্তু কতটা সংবেদনশীল এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই বাধা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রটি তার মূল বার্তা অক্ষুণ্ণ রেখে দর্শকদের কাছে পৌঁছেছে।

বক্স অফিসে চ্যালেঞ্জ

যদিও ‘ধড়ক ২’ সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে, বক্স অফিসে এর পারফরম্যান্স ছিল সীমিত প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এটি প্রমাণ করে যে ভারতীয় দর্শকরা এখনও জাতিভেদ কেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত নয়।

তামিল মূলের সাথে তুলনা: পরিয়েরুম পেরুমাল

‘ধড়ক ২’ তামিল চলচ্চিত্র ‘পরিয়েরুম পেরুমাল’ (২০১৮) এর রিমেক হলেও, এটি মূল কাহিনীর চেয়েও এগিয়ে গেছে কিছু ক্ষেত্রে। বিশেষত নারী ক্ষমতায়ন এবং আম্বেদকরীয় আদর্শের উপস্থাপনায় এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

শিল্পীদের অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা বাস্তবতা

সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী এবং ত্রিপ্তি ডিমরি দুজনেই তাদের চরিত্রে গভীর জীবন্ততা এনেছেন। বিশেষভাবে সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী নীলেশের চরিত্রে সিস্টেমিক অবিচারে আটকে পড়া একজন যুবকের যন্ত্রণা এবং প্রতিরোধ উভয়ই ফুটিয়ে তুলেছেন।

“ভাইজান” সলমন খানের দশটি চমকপ্রদ অজানা তথ্য: বলিউডের সুপারস্টারের অন্তরালের গল্প

সাপোর্টিং ক্যাস্টের শক্তিশালী অভিনয়

জাকির হোসেন (প্রিন্সিপাল চরিত্রে) এবং সৌরভ সচদেব (খলনায়ক শংকর চরিত্রে) উভয়েই তাদের চরিত্রে প্রভাবশালী অভিনয় করেছেন। বিশেষত সৌরভ সচদেব একজন জাতিগত বিশুদ্ধতার স্বঘোষিত রক্ষক হিসেবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন।

ভবিষ্যতের বলিউডের জন্য দিকনির্দেশনা

‘ধড়ক ২’-এর সাফল্য এবং সমালোচনা উভয়ই ভবিষ্যৎ বলিউড চলচ্চিত্রের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে: জাতিগত সুবিধার প্রশ্নে অনুসন্ধান, ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথা এবং পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের নারীদের উৎসাহিত করা, এবং ক্ষমতায়িত কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে জাতিভিত্তিক শত্রুতার মোকাবেলা।

‘ধড়ক ২’ নিঃসন্দেহে একটি র্যাডিক্যাল বর্ণবিরোধী প্রকল্প যা বলিউডের ঐতিহ্যগত নীরবতা ভেঙে দিয়েছে। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন দলিত চেহারার স্টেরিওটাইপ এড়ানো যায়নি, তবুও এটি ভারতীয় সিনেমায় জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে একটি সাহসী এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শাজিয়া ইকবালের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরও পরিচালকদের অনুপ্রাণিত করবে সমাজের এই জটিল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে।

Share This Article