বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বহু প্রতীক্ষিত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল দেব অভিনীত এবং ধ্রুব ব্যানার্জী পরিচালিত ‘রঘু ডাকাত’। বাংলার এক কিংবদন্তি ডাকাত, যিনি ধনীদের থেকে লুট করে গরিবদের বিলিয়ে দিতেন, সেই রবিনহুড-সম চরিত্রকে পর্দায় দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। দেবের শারীরিক রূপান্তর, বিশাল সেট এবং অ্যাকশনের ঝলক প্রত্যাশার পারদ চড়িয়েছিল। কিন্তু মুক্তির পর সেই প্রত্যাশার কতটা পূরণ হলো? ছবিটি কি বাংলার নিজস্ব ঘরানার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠতে পারল, নাকি দক্ষিণী ‘মাসালা’ সিনেমার একটি কার্বন কপি হয়েই রয়ে গেল? এই রিভিউতে আমরা সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব, সাথে থাকবে ছবির পারফরম্যান্সের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ।
‘রঘু ডাকাত’ ছবিটি আদতে বাংলার এক লোকগাথার আধুনিকীকরণ, যেখানে অ্যাকশন, ড্রামা এবং স্কেলকে বড় করে দেখানো হয়েছে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই সমালোচক এবং দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদল যেমন দেবের কঠোর পরিশ্রম এবং ছবির বিশাল আয়োজনের প্রশংসা করেছেন, তেমনই অন্যদল গল্পের গভীরতার অভাব এবং দক্ষিণী সিনেমার অন্ধ অনুকরণের অভিযোগ তুলেছেন। এই ছবিটি মূলত সেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যা আজকের বাংলা সিনেমার গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে — নিজস্বতা নাকি প্যান-ইন্ডিয়া আবেদন?
গল্পের গভীরে: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও চিত্রনাট্যের বুনন
‘রঘু ডাকাত’ কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। অষ্টাদশ শতকের বাংলায় হুগলি, বর্ধমান এবং নদীয়া জেলায় তাঁর আধিপত্য ছিল। তিনি ছিলেন গরিবের ত্রাতা এবং ব্রিটিশ ও জমিদারদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জী এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে একটি ফিকশনাল গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। ছবির চিত্রনাট্য রঘু’র উত্থান, তাঁর সংগ্রাম এবং ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
চিত্রনাট্যের শক্তি এবং দুর্বলতা
শক্তি:
- শক্তিশালী সূচনা: ছবির প্রথম ভাগ বেশ টানটান। রঘু’র ডাকাত হয়ে ওঠার পেছনের কারণ এবং তার প্রাথমিক কার্যকলাপগুলো দর্শকদের গল্পের সাথে যুক্ত করে।
- কিছু আবেগঘন মুহূর্ত: বিশেষ করে রঘু’র সাথে তার মায়ের সম্পর্ক এবং গ্রামের মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতার দৃশ্যগুলো ভালো লাগে।
দুর্বলতা:
- ঐতিহাসিক গভীরতার অভাব: ছবিটি রঘু ডাকাতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা সেই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সেভাবে তুলে ধরতে পারেনি। ব্রিটিশ লাইব্রেরির আর্কাইভ অনুযায়ী, সেই সময়ে বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি এবং ব্রিটিশদের শোষণ এক জটিল আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু ছবিতে এই বিষয়গুলোকে সরলীকৃত করে শুধুমাত্র একটি প্রতিশোধের গল্পে পরিণত করা হয়েছে।
- দ্বিতীয়ার্ধের গতি: ছবির দ্বিতীয়ার্ধ কিছুটা গতি হারায় এবং অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে। ক্লাইম্যাক্স আরও জোরালো হতে পারত। সংলাপ অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক শোনায়, যা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাথে বেমানান।
গল্পের বুননে ঐতিহাসিক সত্যতা এবং বাণিজ্যিক সিনেমার উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করা হলেও, পাল্লাটি বাণিজ্যিক দিকের চেয়েই বেশি ভারী মনে হয়।
দেবের রূপান্তর: ‘রঘু’ রূপে কতটা সফল?
এই ছবির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নিঃসন্দেহে দেব। ‘চাঁদের পাহাড়’ বা ‘আমাজন অভিযান’-এর পর আরও একবার শারীরিক এবং মানসিক স্তরে একটি চরিত্রের জন্য তিনি যে বিপুল পরিশ্রম করেছেন, তা পর্দায় স্পষ্ট। তার পেশিবহুল চেহারা, চোখের আগুন এবং অ্যাকশন দৃশ্যে স্বাচ্ছন্দ্য প্রশংসার যোগ্য।
তবে অভিনয়ের সূক্ষ্মতার জায়গায় কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। ‘রঘু’ চরিত্রটি যতটা শারীরিক শক্তির প্রদর্শন করে, ততটা মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বা গভীরতা প্রকাশ করতে পারে না। অনেক দৃশ্যে তাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিরো হিসেবেই দেখানো হয়েছে, যার ফলে চরিত্রটির মানবিক দিকগুলো কিছুটা চাপা পড়ে গেছে। তার অভিনয় অনেকটা ‘কেজিএফ’-এর রকি ভাই বা ‘পুষ্পা’-র পুষ্পারাজের মতো চরিত্রগুলোর দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়, যা চরিত্রের বাঙালি সত্ত্বাকে দুর্বল করে দেয়।
সহ-অভিনেতাদের মধ্যে রঘু’র মায়ের চরিত্রে এবং প্রধান খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় উল্লেখযোগ্য। তবে চিত্রনাট্যে তাদের চরিত্রগুলোকে আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা একটি বড় খামতি।
পরিচালনার কারিগরি ও দক্ষিণী ঘরানার প্রভাব
পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জী ‘গোলন্দাজ’ বা ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’-এর মতো ছবিতে নিজের জাত চিনিয়েছেন। ‘রঘু ডাকাত’-এ তার পরিচালনার মুন্সিয়ানা ক্যামেরার কাজে এবং অ্যাকশন সিকোয়েন্সের কম্পোজিশনে দেখা যায়। কিন্তু ছবির মূল সমস্যা হলো এর ট্রিটমেন্ট। ছবিটি আগাগোড়া একটি দক্ষিণী ‘মাস’ এন্টারটেইনারের মতো করে বানানো হয়েছে।
দক্ষিণী সিনেমার প্রভাব:
- স্লো-মোশন অ্যাকশন: প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্যে অত্যাধিক স্লো-মোশনের ব্যবহার করা হয়েছে, যা আজকালকার তেলুগু বা কন্নড় সিনেমার একটি সিগনেচার স্টাইল।
- ওভার-দ্য-টপ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর (BGM): ছবির আবহ সঙ্গীত অত্যন্ত চড়া এবং অনেক সময় সংলাপকেও ছাপিয়ে যায়। শান্ত বা আবেগঘন দৃশ্যেও অপ্রয়োজনীয়ভাবে উচ্চকিত BGM ব্যবহার করা হয়েছে।
- হিরোইজম প্রতিষ্ঠা: নায়কের প্রতিটি কাজের মহিমান্বিতকরণ এবং অবাস্তব অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বাংলার মাটির গল্পের চেয়ে দক্ষিণী ফ্যান্টাসি জগতের কথাই বেশি মনে করায়। দ্য হিন্দু’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, প্যান-ইন্ডিয়া সিনেমার এই ফর্মুলা বক্স অফিসে সাফল্য আনলেও আঞ্চলিক সিনেমার নিজস্বতাকে নষ্ট করছে। ‘রঘু ডাকাত’-এর ক্ষেত্রেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে।
- ভিজ্যুয়াল এবং কালার টোন: ছবির কালার গ্রেডিং এবং ভিজ্যুয়াল এফেক্টসেও (VFX) ‘কেজিএফ’ বা ‘আরআরআর’-এর মতো ছবির ছায়া স্পষ্ট। ধূসর, মাটির রঙের টোন ব্যবহার করে একটি ‘ডার্ক’ এবং ‘র’ ফিল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই অতিরিক্ত ‘দক্ষিণী’ অনুপ্রেরণার ফলে ছবিটি তার নিজস্ব পরিচয় হারিয়েছে। বাংলার একজন ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে তৈরি ছবিতে বাংলার লোকসংস্কৃতি, গান বা জীবনযাত্রার ছাপ প্রায় নেই বললেই চলে।
বক্স অফিস এবং দর্শকদের প্রতিক্রিয়া: পরিসংখ্যান কী বলছে?
যেকোনো বাণিজ্যিক সিনেমার চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করে তার বক্স অফিস পারফরম্যান্সের ওপর। ‘রঘু ডাকাত’ বক্স অফিসে একটি মিশ্র শুরু করেছে। যদিও ছবির বাজেট এবং প্রচারের কারণে প্রাথমিক আয় ভালো, তবে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য দর্শকদের মুখের কথার (word-of-mouth) ওপর নির্ভরশীল।
সিনেমার নাম | প্রথম সপ্তাহের কালেকশন (আনুমানিক) | বাজেট (আনুমানিক) | IMDb রেটিং (প্রথম সপ্তাহে) |
রঘু ডাকাত (২০২৫) | ₹৪.৫ কোটি | ₹১৫ কোটি | ৬.৮/১০ |
চেঙ্গিজ (২০২৩) | ₹২.৮ কোটি | ₹৮ কোটি | ৬.৫/১০ |
প্রজাপতি (২০২২) | ₹৫.০ কোটি | ₹৪ কোটি | ৮.২/১০ |
KGF: Chapter 2 (Bengal Circuit) | ₹১০ কোটি+ | N/A | ৮.৩/১০ |
(তথ্যসূত্র: বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি ট্র্যাকার এবং সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট)
উপরের টেবিল থেকে বোঝা যায়, ‘রঘু ডাকাত’ সাম্প্রতিক কালের অন্যান্য বড় বাংলা ছবির তুলনায় ভালো শুরু করলেও, ‘প্রজাপতি’-র মতো কন্টেন্ট-নির্ভর ছবির প্রথম সপ্তাহের আয়কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। অন্যদিকে, বাংলায় ডাব করা দক্ষিণী ছবি ‘KGF: 2’-এর আয়ের তুলনায় এর পারফরম্যান্স অনেকটাই দুর্বল। এটি প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র অ্যাকশন বা স্কেল দিয়ে বাংলার দর্শকদের মন জয় করা কঠিন, যদি না গল্পের সাথে একটি আত্মিক সংযোগ তৈরি হয়। IMDb এবং BookMyShow-এর মতো প্ল্যাটফর্মে দর্শকদের রেটিংও মিশ্র।
বাংলা সিনেমার নতুন দিক? নাকি নিজস্বতা হারানোর ভয়?
‘রঘু ডাকাত’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলা সিনেমা কি টিকে থাকার জন্য সর্বভারতীয় বাজারের দিকে তাকিয়ে নিজের শিকড় থেকে সরে আসবে?
সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক:
- বড় বাজেটের ছবি তৈরিতে প্রযোজকদের উৎসাহিত করা।
- প্রযুক্তিগত দিক থেকে বাংলা সিনেমার উন্নতি।
- অন্যান্য রাজ্যের দর্শকদের কাছে বাংলা সিনেমাকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা।
সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক:
- গল্পের মৌলিকত্ব এবং বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে যাওয়া।
- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের মতো পরিচালকদের তৈরি করা বাংলা সিনেমার যে নিজস্ব ভাষা ছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হওয়া।
- ফর্মুলা-ভিত্তিক সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়া, যা শিল্পের চেয়ে ব্যবসাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
আনন্দবাজার পত্রিকার একটি বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, টলিউডের অনেক পরিচালক এবং শিল্পীই এই “প্যান-ইন্ডিয়া” ট্রেন্ড নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। তাদের মতে, সর্বভারতীয় আবেদন তৈরি করতে গিয়ে যদি বাংলা সিনেমার আত্মাটাই হারিয়ে যায়, তবে সেই সাফল্য অর্থহীন।
শেষ কথা
‘রঘু ডাকাত’ একটি উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেবের समर्पण এবং ছবির টেকনিক্যাল দিকগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। আপনি যদি শুধুমাত্র একটি অ্যাকশন-প্যাকড মাসালা সিনেমা দেখতে চান, যেখানে যুক্তি বা ইতিহাসের চেয়ে বিনোদনই মুখ্য, তবে এই ছবি আপনার ভালো লাগতে পারে।
তবে আপনি যদি বাংলার ইতিহাস বা লোকগাথার একটি বিশ্বস্ত চিত্রায়ণ আশা করেন, অথবা বাংলা সিনেমার নিজস্বতার খোঁজে হলে যান, তবে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ‘রঘু ডাকাত’ বাংলার গল্প বলতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত একটি দক্ষিণী সিনেমার ছায়া হয়েই রয়ে গেছে। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন কিন্তু আত্মাহীন প্রচেষ্টা।
রেটিং: ২.৫/৫ ⭐⭐✨