ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই) রাজস্থানের দেগ জেলার বাহাজ গ্রামে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছে যা পুরাণ ও ইতিহাসের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে। প্রায় ৪৫০০ বছরের প্রাচীন এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের সাথে পাওয়া গেছে ২৩ মিটার গভীর একটি প্রাচীন নদীখাত, যার সাথে ঋগ্বেদে উল্লিখিত সরস্বতী নদীর যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এই আবিষ্কার শুধু ভারতের প্রাচীন ইতিহাসেই নয়, বরং পৌরাণিক কাহিনীর সত্যতার ক্ষেত্রেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই খনন কাজে এখন পর্যন্ত ৮০০টিরও বেশি মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রাচীনতম ব্রাহ্মী লিপির সিলমোহর, তামার মুদ্রা, যজ্ঞকুণ্ড, মৌর্য যুগের ভাস্কর্য, শিব-পার্বতীর মূর্তি এবং হাড় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আবিষ্কার ভারতীয় উপমহাদেশে হাড়ের সরঞ্জাম ব্যবহারের অন্যতম প্রাচীন প্রমাণ।
৫০০০ বছর আগে তৈরী হয় বোতাম! ইতিহাস জানলে চমকে উঠবেন আপনি
খননকার্যে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি বিশ্লেষণ করে প্রত্নতত্ববিদরা মনে করছেন এখানে পাঁচটি যুগের নিদর্শন রয়েছে1। সেখানে হরপ্পা, মহাভারত, মৌর্য, কুষাণ এবং গুপ্ত যুগের চিহ্ন পাওয়া গেছে। রাজস্থানের মাটি থেকে এত গভীরে এর আগে কোনও সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়নি1। মাটির কাজ মহাভারতের যুগের সঙ্গে মিল রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল সরস্বতী নদীর একটি যোগাযোগের টানেল যা সকলকে অবাক করেছে। এএসআই-এর খনন প্রধান পবন সরস্বত জানিয়েছেন, “এই জলপ্রবাহের প্রমাণ সরস্বতী উপত্যকা, ব্রজ ও মথুরা অঞ্চলের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী ছিল, এটা প্রমাণ করে”। এই নদীখাতটি প্রাচীন মানব বসতির জন্ম দিতে সাহায্য করেছিল এবং সরস্বতী অববাহিকা সংস্কৃতির সঙ্গে বাহাজকে যুক্ত করেছিল।
খননস্থলে একটি বিরাট যজ্ঞের স্থান পাওয়া গিয়েছে এবং মোট ১৫টি যজ্ঞের কুন্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। পাশাপাশি ত্রিকোণ এবং চতুর্ভুজের ছবি মিলেছে। এছাড়াও টেরাকোটার শিব-পার্বতীর মূর্তি, শাঁখের চুড়ি এবং মূল্যবান পাথরের পুঁতির খোঁজ মিলেছে। এই সব প্রাচীন নিদর্শন সেই সময়ের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়2। এখানে একটি মানুষের কঙ্কাল মিলেছে যেটিকে ইজরায়েলে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীকে বৈদিক সভ্যতার বৃহত্তম এবং প্রধান নদী হিসেবে বিবেচনা করা হত। ঋগ্বেদের নদীস্তুতি সূক্তে বলা হয়েছে সরস্বতী নদীটি পূর্বে যমুনা ও পশ্চিমে শতদ্রু নদীর মধ্যভাগে অবস্থিত। পরবর্তীকালীন বৈদিক সাহিত্যে এবং মহাভারতেও উল্লিখিত হয়েছে যে সরস্বতী নদী একটি মরুভূমিতে শুকিয়ে গিয়েছে।
ইসরোর গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, আজও সরস্বতী নদী হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং রাজস্থানের মধ্য দিয়ে ভূগর্ভে প্রবাহিত হয়। ২০০২ সালে ‘ডাউন টু আর্থ’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, হরপ্পা সভ্যতার সময় এই নদীটির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতার বেশ কিছু অংশ গড়ে উঠেছিল এই নদীর তীরে।
ভূপদার্থবৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে যে ১০,০০০-৮,০০০ বছর আগে শতদ্রু গতিপথ পরিবর্তন করলে ঘগ্গর-হকরা নদী ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র বর্ষার জলে পুষ্ট এমন এক নদী ব্যবস্থায় পরিণত হয় যা সমুদ্রে পৌঁছায় না। প্রায় ৫,০০০ বছর আগে যখন নদীগুলিকে পরিপুষ্টকারী বর্ষার অবনতি ঘটে তখনই সিন্ধু সভ্যতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।
সিন্ধু সভ্যতার কালীবঙ্গা (রাজস্থান), বনাবলী ও রাখীগঢ়ী (হরিয়াণা), ধোলাবীরা ও লোথাল (গুজরাত) প্রভৃতি নগরকেন্দ্রগুলি এই নদীগুলির অববাহিকাতেই অবস্থিত ছিল। প্রায় ৪,০০০ বছর আগে নদীগুলিকে পরিপুষ্টকারী বর্ষার আরও অবনতি ঘটলে হকরা শুকিয়ে গিয়ে একটি সবিরাম নদীতে পরিণত হয় এবং নগরাঞ্চলীয় হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে।
সরস্বতী প্রণাম মন্ত্র: বিদ্যার দেবীর আশীর্বাদ লাভের পথ
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতেও একটি সরস্বতী নদী ছিল যা ভাগীরথী নদীর একটি শাখানদী। এটি ১৬ শতক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল, কিন্তু বর্তমানে এর প্রায় অস্তিত্ব নেই। হুগলির সপ্তগ্রাম ছিল প্রধান নদীবন্দর, যেখানে গঙ্গা ও তার দুই প্রধান শাখানদী যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল ছিল।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে যে, বহু বছর আগে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এর ফলে মাটির নীচের পাহাড় উপরে উঠে যায় এবং সরস্বতী নদীর জল পিছনের দিকে চলে যায়। এরপর সরস্বতী নদী যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে তার সঙ্গেই প্রবাহিত হতে থাকে।
রাজস্থানে আবিষ্কৃত এই প্রাচীন সভ্যতা শুধুমাত্র ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে নয়, বরং পৌরাণিক গ্রন্থের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সরস্বতী নদীর অস্তিত্বের এই প্রমাণ দেখায় যে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রগুলি শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনী নয়, বরং বাস্তব ইতিহাসের ভিত্তিতে রচিত। এই আবিষ্কার ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাচীন সভ্যতার গভীরতাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে।