প্রাথমিকভাবে তিনি মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে শাসন করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জন করেন। তিনি তাঁর রাজধানী আম্বের থেকে নতুন নির্মিত জয়পুর শহরে স্থানান্তরিত করেন।জয়পুর শহর নির্মাণের পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। আম্বের শহর পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সেখানে আর সম্প্রসারণের সুযোগ ছিল না। তাছাড়া খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে আম্বের রাজধানী হিসেবে অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। জয় সিং একটি এমন জায়গা খুঁজছিলেন যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং তাঁর রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।তিনি বাংলা থেকে স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে নিয়োগ করেন, যিনি রাজার প্রধান নিরীক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।
বিদ্যাধর ভট্টাচার্য প্রাচীন হিন্দু নগর পরিকল্পনার নীতি “বাস্তু শাস্ত্র” অনুসরণ করে শহরের নকশা তৈরি করেন। এই নীতি অনুসারে বাড়ি, শহর এবং বাগানের নকশা ও বিন্যাস এমনভাবে করা হয় যাতে স্থাপত্য প্রকৃতির সাথে সর্বোত্তমভাবে মিশে যায়।জয়পুর শহরের নকশায় একটি গ্রিড পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে শহরটিকে নয়টি বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি বর্গক্ষেত্র বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রের নয়টি গ্রহের প্রতীক হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল। চওড়া রাস্তাগুলি সমকোণে একে অপরকে ছেদ করেছিল, যা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে তুলেছিল।শহরের চারপাশে একটি বড় প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল যা আক্রমণকারীদের থেকে রক্ষা করত। প্রাচীরে প্রবেশদ্বার ছিল, যার কিছু জ্যোতিষ্ক পদার্থের নামে নামকরণ করা হয়েছিল। পূর্বদিকে “সূর্য” দ্বার এবং পশ্চিমদিকে “চন্দ্র” দ্বার ছিল।জয়পুর শহরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছিল। জয় সিং জন্তর মন্তর নামক একটি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণাগার নির্মাণ করেন, যেখানে প্রায় ২০টি জ্যোতির্বিজ্ঞান যন্ত্র এবং বিশ্বের বৃহত্তম পাথরের সূর্যঘড়ি রয়েছে।
কলকাতার ট্রামের একাল ও সেকাল: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
এছাড়াও হাওয়া মহল নামে একটি পাঁচতলা প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখান থেকে রাজপরিবারের মহিলারা শহরের দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখতে পারতেন।১৮৫৩ সালে যখন ওয়েলসের রাজকুমার জয়পুর ভ্রমণে আসেন, তখন রাজা সমস্ত ভবন গোলাপী রঙে রঙিন করার নির্দেশ দেন। গোলাপী রং ঐতিহ্যগতভাবে স্বাগত ও আতিথেয়তার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। সেই থেকে জয়পুর “পিঙ্ক সিটি” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।জয়পুর শহর নির্মাণের ফলে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এটি ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর হিসেবে একটি মডেল হয়ে উঠেছিল। শহরের সুন্দর পরিকল্পনা ও স্থাপত্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শহর নির্মাণকে প্রভাবিত করেছিল। বাণিজ্য ও বাণিজ্যের জন্য একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্র হিসেবে জয়পুর দ্রুত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।
জয়পুরের স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা এতটাই উল্লেখযোগ্য ছিল যে ২০১৯ সালে UNESCO এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। UNESCO-এর মতে, “জয়পুরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর নগর পরিকল্পনা, যা সওয়াই জয় সিং নিজে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বেশ কয়েকটি নগর পরিকল্পনার বিশ্লেষণের পর তৈরি করেছিলেন।”জয়পুর শহর আজও ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ঐতিহাসিক স্থাপত্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জীবন্ত বাজারগুলি প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটককে আকর্ষণ করে। শহরের প্রাচীর, দরজা এবং প্রধান স্মৃতিসৌধগুলি আজও তাদের মূল অবস্থায় রয়েছে।
জয়পুর শহর নির্মাণের পিছনে মহারাজা সওয়াই জয় সিং দ্বিতীয়ের দূরদর্শিতা ও বিজ্ঞান-মনস্কতা প্রশংসনীয়। তিনি শুধু একটি সুন্দর শহরই নির্মাণ করেননি, বরং একটি টেকসই ও কার্যকরী শহর গড়ে তুলেছিলেন যা তিনশো বছর পরেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জয়পুর শহর ভারতীয় স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও আধুনিক পরিকল্পনার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল।