Rakhi Purnima 2025 date: ভাই-বোনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে বাঁধা। এই সম্পর্কে যেমন আছে খুনসুটি, তেমনই আছে অফুরন্ত ভালোবাসা আর নির্ভরতা। আর এই পবিত্র সম্পর্ককে উদযাপন করার সবচেয়ে বড় উৎসব হল রাখি পূর্ণিমা বা রক্ষা বন্ধন। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। বোনেরা ভাইদের হাতে রাখি পরিয়ে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করে, আর ভাইয়েরা বোনকে আজীবন রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই একটা দিন যেন সমস্ত ভাই-বোনের কাছে একরাশ আনন্দ আর স্মৃতি নিয়ে আসে। তাই উৎসবের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। সকলের মনেই প্রশ্ন জাগে, পরের বছর রাখি কবে পড়ছে? আপনার মনের এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন। ২০২৫ সালে রাখি পূর্ণিমা পালিত হবে ৯ই আগস্ট, শনিবার।
এই দিনটি শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি ভাই-বোনের মধ্যেকার স্নেহ, ভালোবাসা এবং সুরক্ষার এক জীবন্ত প্রতীক। সারা ভারত জুড়ে এই উৎসব বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। আসুন, আমরা ২০২৫ সালের রাখি পূর্ণিমা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নিই, যাতে আপনি আগে থেকেই এই বিশেষ দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন।
২০২৫ সালে রাখি পূর্ণিমা কবে?
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাখি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুযায়ী, ২০২৫ সালে রাখি পূর্ণিমা উৎসবের দিন হল ৯ই আগস্ট, শনিবার।
তবে, তিথি বা পূর্ণিমার সময়কাল দুই দিন ধরে বিস্তৃত থাকতে পারে। ২০২৫ সালের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে।
-
পূর্ণিমা তিথি শুরু: ৮ই আগস্ট, ২০২৫, শুক্রবার, দুপুর ০২:১২ মিনিটে।
-
পূর্ণিমা তিথি শেষ: ৯ই আগস্ট, ২০২৫, শনিবার, দুপুর ০১:২৪ মিনিটে।
যেহেতু হিন্দু ধর্মে উদীয়মান সূর্যের তিথিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাই মূল উৎসবটি ৯ই আগস্ট পালিত হবে।
রাখি বাঁধার শুভ মুহূর্ত
যেকোনো শুভ কাজ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বা মুহূর্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা “শুভ মুহূর্ত” নামে পরিচিত। রাখি বাঁধার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। শাস্ত্র মতে, সঠিক সময়ে রাখি বাঁধলে তা ভাই-বোনের সম্পর্কের জন্য মঙ্গলজনক হয়।
২০২৫ সালে রাখি বাঁধার জন্য একটি দীর্ঘ শুভ সময় পাওয়া যাবে। সবচেয়ে ভালো খবর হল, এই বছর রাখি বাঁধার সময় ভাদ্রকালের কোনও ছায়া থাকছে না, কারণ ভাদ্রকাল ৯ই আগস্ট সূর্যোদয়ের আগেই समाप्त হয়ে যাবে। তাই সারাদিনই রাখি বাঁধার জন্য শুভ বলে মনে করা হচ্ছে।
-
রাখি বাঁধার শুভ সময়: ৯ই আগস্ট, ২০২৫, শনিবার, সকাল ০৫:৪৭ মিনিট থেকে দুপুর ০১:২৪ মিনিট পর্যন্ত।
-
শুভ মুহূর্তের মোট সময়কাল: প্রায় ৭ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট।
শাস্ত্র অনুযায়ী, অপরাহ্ন অর্থাৎ দুপুরের সময়টি রাখি বাঁধার জন্য সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। যদি কোনো কারণে সেই সময়ে সম্ভব না হয়, তবে প্রদোষকালেও রাখি বাঁধা যেতে পারে। তবে ভাদ্র সময়ে রাখি বাঁধা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ কারণ এই সময়টিকে অশুভ বলে মনে করা হয়।
রাখি পূর্ণিমার তাৎপর্য ও গুরুত্ব
“রক্ষা বন্ধন” কথাটির মধ্যেই এর আসল অর্থ লুকিয়ে আছে। সংস্কৃতে ‘রক্ষা’ শব্দের অর্থ হল সুরক্ষা এবং ‘বন্ধন’ মানে হল বাঁধন। অর্থাৎ, এটি সুরক্ষার বাঁধন। এই দিনে বোনেরা ভাইদের হাতে যে পবিত্র সুতো বা রাখি বেঁধে দেয়, তা কেবল একটি সুতো নয়, এটি তাদের স্নেহ, বিশ্বাস এবং প্রার্থনার প্রতীক।
এই উৎসবের গুরুত্ব অনেক গভীর। এটি শুধু ভাই-বোনের জৈবিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নয়, বরং যেকোনো নারী-পুরুষের মধ্যেকার পবিত্র ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককেও সম্মান জানায়। একটি মেয়ে যখন কোনো বন্ধু বা পরিচিতকে ভাই হিসেবে বরণ করে রাখি পরায়, তখন সেই সম্পর্কও একই মর্যাদা পায়। এই উৎসব সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াতে সাহায্য করে এবং “বসুধৈব কুটুম্বকম” (গোটা বিশ্বই একটি পরিবার) – এই মহান ধারণাকে তুলে ধরে।
রাখি উৎসবের পেছনের পৌরাণিক কাহিনী
রাখি পূর্ণিমার প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং দ্রৌপদীর কাহিনী।
মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, একবার শিশুপালকে বধ করার সময় শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রে তাঁর আঙুল কেটে রক্তপাত হতে শুরু করে। সেই সময় রাজসভায় উপস্থিত সকলে যখন কেবলই ছোটাছুটি করছিলেন, তখন দ্রৌপদী কোনও দ্বিধা না করে নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের আঙুলে বেঁধে দেন। দ্রৌপদীর এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় শ্রীকৃষ্ণ আপ্লুত হন এবং তাঁকে वचन দেন যে, প্রয়োজনে তিনি এর প্রতিদান দেবেন এবং সর্বদা তাঁকে রক্ষা করবেন। পরবর্তীকালে, কৌরবদের রাজসভায় যখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করার চেষ্টা করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন এবং দ্রৌপদীর সম্মান বাঁচিয়েছিলেন। মনে করা হয়, সেই দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথি এবং সেদিন থেকেই রাখি উৎসবের প্রচলন হয়।
রাখি উৎসবের প্রস্তুতি ও পালন
রাখি উৎসবকে ঘিরে প্রতিটি বাড়িতেই এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়। উৎসবের কয়েক দিন আগে থেকেই বাজারগুলি সুন্দর সুন্দর রাখিতে ভরে যায়। বোনেরা তাদের ভাইদের জন্য পছন্দের রাখি কেনে।
উৎসবের দিন বোনেরা স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে পূজার থালি সাজায়। সেই থালিতে থাকে:
-
রাখি: ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় পবিত্র সুতো।
-
প্রদীপ: অশুভ শক্তিকে দূর করার প্রতীক।
-
রোলি বা চন্দন: তিলক লাগানোর জন্য।
-
অক্ষত (চাল): দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
-
মিষ্টি: সম্পর্কের মাধুর্য বজায় রাখার জন্য।
এরপর বোনেরা ভাইয়ের আরতি করে, তার কপালে তিলক লাগিয়ে দেয় এবং ডান হাতের কব্জিতে রাখি বেঁধে দেয়। রাখি বাঁধার সময় তারা ভাইয়ের সুস্বাস্থ্য, সাফল্য এবং দীর্ঘ জীবন কামনা করে। ভাইয়েরা বোনদের উপহার দেয় এবং সারাজীবন তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়ে ওঠে।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রাখি উদযাপন
ভারত বৈচিত্র্যের দেশ, তাই রাখি উৎসবও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে এবং রীতিতে পালিত হয়।
-
পশ্চিমবঙ্গ: পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি “ঝুলন পূর্ণিমা” নামেও পরিচিত। এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার পূজা করা হয় এবং मंदिराগুলিতে ঝুলন যাত্রার আয়োজন করা হয়।
-
মহারাষ্ট্র: মহারাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে কোলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই দিনটিকে “নারলি পূর্ণিমা” বা নারকেল পূর্ণিমা হিসেবে পালন করে। তারা সমুদ্র দেবতাকে নারকেল উৎসর্গ করে এবং ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনা করে।
-
উত্তর ভারত: উত্তর ভারতে এই উৎসব অত্যন্ত ধুমধাম করে পালিত হয়। পরিবারের সবাই একত্রিত হয়, বিশেষ খাবার-দাবার তৈরি হয় এবং উপহার বিনিময় চলে।
রাখি পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসব যা ভালোবাসার বন্ধনকে সম্মান জানায়। ২০২৫ সালের ৯ই আগস্ট, শনিবার, এই বিশেষ দিনে ভাই-বোনেরা তাদের সম্পর্ককে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। দূরত্বের কারণে যারা একত্রিত হতে পারেন না, তারাও প্রযুক্তির সাহায্যে বা ডাকযোগে রাখি পাঠিয়ে এই উৎসবে সামিল হন। এই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভালোবাসার বাঁধন যেকোনো দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই পবিত্র উৎসবকে সার্থক করে তুলি।