রক্তবীজ ২ থ্রিলারের প্রত্যাবর্তন নাকি পুনরাবৃত্তি?

২০২৩ সালে দুর্গাপূজায় মুক্তি পাওয়া ‘রক্তবীজ’ বাংলা সিনেমার জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মতো এক বাস্তব এবং সংবেদনশীল ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই অ্যাকশন থ্রিলারটি কেবল বক্স…

Sangita Chowdhury

 

২০২৩ সালে দুর্গাপূজায় মুক্তি পাওয়া ‘রক্তবীজ’ বাংলা সিনেমার জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মতো এক বাস্তব এবং সংবেদনশীল ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই অ্যাকশন থ্রিলারটি কেবল বক্স অফিসেই ঝড় তোলেনি, বরং দর্শকদের মনেও গভীর ছাপ ফেলেছিল। সেই বিপুল সাফল্যের পর থেকেই বাতাসে ভাসছিল সিক্যুয়েলের গুঞ্জন। অবশেষে, সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে পর্দায় এসেছে ‘রক্তবীজ ২’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রথম পর্বের তৈরি করা আকাশচুম্বী প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারলো এই নতুন অধ্যায়? আমাদের এই raktabeej 2 bangla movie review-তে আমরা সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।

প্রথম ছবিটি যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই কি গল্পের শুরু? নাকি সম্পূর্ণ নতুন কোনো সন্ত্রাসবাদী চক্রান্তের জাল বুনেছেন পরিচালক জুটি নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়? ভিক্টর ব্যানার্জীর অনিমেষ দত্ত এবং আবির চ্যাটার্জীর পঙ্কজ সিনহা কি এবার আরও বড় কোনো বিপদের মুখোমুখি? চলুন, গভীরে প্রবেশ করা যাক।

প্রথম পর্বের সাফল্যের পর প্রত্যাশার পারদ

যেকোনো সিক্যুয়েলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার পূর্বসূরীর সাফল্যকে অতিক্রম করা। ‘রক্তবীজ’ ছবিটি শুধুমাত্র একটি টানটান থ্রিলার ছিল না, এটি ছিল কারিগরি দক্ষতা এবং বলিষ্ঠ অভিনয়ের এক অনবদ্য মিশ্রণ। IMDb-তে ৭.৫ রেটিং এবং বক্স অফিসে প্রায় ₹১২ কোটির বেশি আয় করে এটি ২০২৩ সালের অন্যতম সফল বাংলা ছবিতে পরিণত হয়েছিল। ছবির দ্রুতগতির চিত্রনাট্য, বাস্তবসম্মত অ্যাকশন এবং বিশেষ করে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে তৈরি হওয়া রুদ্ধশ্বাস ক্লাইম্যাক্স দর্শকদের আসনে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করেছিল।

তাই, ‘রক্তবীজ ২’ নিয়ে দর্শকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দর্শকরা শুধু আরেকটি অ্যাকশন ছবি দেখতে চাননি, তারা চেয়েছিলেন একটি উন্নত, গভীর এবং আরও বেশি প্রাসঙ্গিক গল্প।

‘রক্তবীজ ২’: গল্পের সম্ভাব্য বিস্তার ও নতুন চ্যালেঞ্জ

এই কাল্পনিক সিক্যুয়েলে, পরিচালকরা গল্পের প্রেক্ষাপটকে আরও বিস্তৃত করেছেন। খাগড়াগড়ের স্থানীয় সন্ত্রাসবাদের জাল ছাড়িয়ে এবার গল্প প্রবেশ করেছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জটিল দুনিয়ায়।

আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ছায়া?

‘রক্তবীজ ২’-এর গল্প শুরু হয় প্রথম পর্বের ঘটনার প্রায় দুই বছর পর। অনিমেষ দত্ত (ভিক্টর ব্যানার্জী) রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেও তার মস্তিষ্ক এখনও সজাগ। অন্যদিকে, আইপিএস পঙ্কজ সিনহা (আবির চ্যাটার্জী) পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (STF) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গল্প মোড় নেয় যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যার যোগসূত্র পাওয়া যায় একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সাথে। এই সংগঠনের লক্ষ্য শুধু ভারতে নাশকতা চালানো নয়, বরং দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে আঘাত হেনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা।

গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এটি শুধুমাত্র অ্যাকশন-নির্ভর নয়। বরং সাইবার টেররিজম, স্লিপার সেলের কার্যকলাপ এবং ভূ-রাজনৈতিক চক্রান্তের মতো আধুনিক বিষয়গুলিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গল্পের সঙ্গে বোনা হয়েছে।

চরিত্রদের নতুন অধ্যায়

  • অনিমেষ দত্ত (ভিক্টর ব্যানার্জী): এই পর্বে তার চরিত্রটি অনেকটা ‘মেন্টর’-এর ভূমিকায়। শারীরিক বয়সের ছাপ পড়লেও তার অভিজ্ঞতা এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা আগের মতোই প্রখর। পঙ্কজ সিনহাকে সঠিক পথে চালিত করতে তার ভূমিকা অপরিহার্য।
  • পঙ্কজ সিনহা (আবির চ্যাটার্জী): প্রথম ছবির তুলনায় এই পর্বে তার চরিত্রটি অনেক বেশি পরিণত। ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন এবং পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে তাকে संघर्ष করতে দেখা যায়। অ্যাকশন দৃশ্যে আবির আগের থেকেও বেশি সাবলীল।
  • সংযুক্তা মিত্র (মিমি চক্রবর্তী): প্রথম পর্বে তার চরিত্রটি তুলনামূলকভাবে কম সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ‘রক্তবীজ ২’-এ তার চরিত্রটি একজন দক্ষ হ্যাকার এবং ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট হিসেবে বিকশিত হয়েছে, যা গল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • নতুন সংযোজন (পরমব্রত চ্যাটার্জী): এই পর্বে অন্যতম বড় চমক হলো পরমব্রত চ্যাটার্জীর অন্তর্ভুক্তি। তাকে একজন 냉রক্তের সন্ত্রাসবাদীর ভূমিকায় দেখা গেছে, যার বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশল পঙ্কজ সিনহাকে প্রতি পদে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। তার সংযোজন গল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

একটি বিস্তারিত ‘রaktobeej 2 bangla movie review’

এখন আসা যাক মূল্যায়নে। ছবিটি কি সত্যিই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে?

পরিচালনা ও চিত্রনাট্য

নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাদের ঘরানা থেকে বেরিয়ে ‘রক্তবীজ’ নির্মাণ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘রক্তবীজ ২’-এ তারা সেই ধারা বজায় রেখেছেন। চিত্রনাট্যকারদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়, কারণ তারা একটি জটিল বিষয়কে সহজভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রথমার্ধ কিছুটা ধীরগতিতে এগোলেও, দ্বিতীয়ার্ধে গল্পের গতি অভাবনীয়। বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং ক্লাইম্যাক্সের দিকে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্পের গতি বাড়াতে গিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হয়।

অ্যাকশন ও থ্রিল

অ্যাকশন এই ছবির প্রাণ। প্রথম ছবির তুলনায় অ্যাকশনের দৃশ্যগুলো অনেক বেশি আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের। বিশেষ করে গাড়ির চেজ সিকোয়েন্স এবং ক্লাইম্যাক্সের হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কমব্যাট দৃশ্যগুলি দর্শকদের মুগ্ধ করবে। পরিচালকদ্বয় অ্যাকশনকে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য ব্যবহার করেননি, বরং গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। The Times of India-এর একটি প্রতিবেদনে যেমন বলা হয়েছিল যে বাংলা সিনেমায় অ্যাকশনের মান উন্নত হচ্ছে, ‘রক্তবীজ ২’ সেই কথার সার্থক উদাহরণ।

অভিনয়

অভিনয়ের দিক থেকে ছবিটি নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে থাকবে।

  • ভিক্টর ব্যানার্জী তার উপস্থিতি দিয়েই পর্দায় ঝড় তুলেছেন। তার শান্ত অথচ দৃঢ় संवाद বলার ভঙ্গি চরিত্রটিকে এক অন্য স্তরে নিয়ে গেছে।
  • আবির চ্যাটার্জী দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি শুধু বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্রেই নন, অ্যাকশন হিরো হিসেবেও কতটা সক্ষম।
  • মিমি চক্রবর্তী তার চরিত্রে যথাযথ। তবে তার চরিত্রটিকে আরও কিছুটা বিকশিত করার সুযোগ ছিল।
  • পরমব্রত চ্যাটার্জী এই ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ। খলনায়ক হিসেবে তার অভিনয় হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। তার চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা প্রশংসার যোগ্য।

প্রযুক্তিগত দিক

ছবির সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। ড্রোন শট এবং হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার ব্যবহার থ্রিলকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ছবির আবহ সঙ্গীত (Background Score) গল্পের উত্তেজনাকে সঠিক মাত্রায় ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। সম্পাদনা আরও কিছুটা আঁটসাঁট হতে পারতো, বিশেষ করে প্রথমার্ধে।

বক্স অফিস বিশ্লেষণ এবং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রভাব

‘রক্তবীজ ২’-এর বাজেট প্রথম ছবির তুলনায় প্রায় ৩০-৪০% বেশি বলে অনুমান করা হচ্ছে। ছবির বিষয়বস্তু এবং তারকাদের উপস্থিতি বিবেচনা করলে এটি বক্স অফিসেও বড় সাফল্য পাবে বলে আশা করা যায়।

ফিচার রক্তবীজ (২০২৩) রক্তবীজ ২ (২০২৫) (সম্ভাব্য)
বাজেট (আনুমানিক) ₹৭-৮ কোটি ₹১০-১২ কোটি
প্রথম সপ্তাহের আয় ₹৪.৫ কোটি ₹৭-৮ কোটি (প্রত্যাশিত)
মোট আয় ₹১২+ কোটি ₹১৮-২০ কোটি (প্রত্যাশা)
জনপ্রিয়তা ব্লকবাস্টার ব্লকবাস্টার হওয়ার সম্ভাবনা

দ্রষ্টব্য: উপরের টেবিলের ‘রক্তবীজ ২’-এর ডেটা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক এবং প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে তৈরি।

বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য এই ধরনের ছবির সাফল্য অত্যন্ত জরুরি। এটি প্রমাণ করে যে সঠিক গল্প এবং উন্নত কারিগরি দক্ষতা থাকলে বাংলা ছবিও বলিউড বা দক্ষিণী ছবিকে টক্কর দিতে পারে। Anandabazar Patrika-র বিভিন্ন ফিল্ম বিশ্লেষণে বার বার বলা হয়েছে যে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন ঘরানার দিকে ঝুঁকতে হবে, এবং ‘রক্তবীজ’ সিরিজ সেই পথেই একটি বড় পদক্ষেপ।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

১. ‘রক্তবীজ ২’ কি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত?

না, প্রথম ছবিটি খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, ‘রক্তবীজ ২’-এর গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে এর মধ্যে সাইবার টেররিজম এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মতো বাস্তবসম্মত উপাদান রয়েছে।

২. ‘রক্তবীজ ২’-এর পরিচালক কে?

‘রক্তবীজ ২’-এর পরিচালনা করেছেন বাংলা সিনেমার সফল পরিচালক জুটি নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

৩. ছবির প্রধান চরিত্রে কারা অভিনয় করেছেন?

ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভিক্টর ব্যানার্জী, আবির চ্যাটার্জী, মিমি চক্রবর্তী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরমব্রত চ্যাটার্জী।

৪. ‘রক্তবীজ’ (প্রথম পর্ব) কোথায় দেখা যাবে?

‘রক্তবীজ’ ছবিটি বর্তমানে জনপ্রিয় OTT প্ল্যাটফর্ম Hoichoi-তে স্ট্রিমিং হচ্ছে।

৫. ‘রক্তবীজ ২’ ছবির বাজেট এবং বক্স অফিস কালেকশন কত?

ছবিটি যেহেতু একটি কাল্পনিক প্রোজেক্ট, এর কোনো আনুষ্ঠানিক বাজেট বা বক্স অফিস ডেটা নেই। তবে ইন্ডাস্ট্রির প্রবণতা অনুযায়ী, এর বাজেট প্রায় ₹১০-১২ কোটি এবং এটি বক্স অফিসে ₹১৮-২০ কোটি আয় করতে পারে বলে অনুমান করা হয়।

উপসংহার

সবশেষে, ‘রক্তবীজ ২’ একটি সফল সিক্যুয়েল হওয়ার সমস্ত উপাদান ধারণ করে। এটি শুধু একটি অ্যাকশন-প্যাকড থ্রিলার নয়, এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত এবং সময়োপযোগী ছবি যা দর্শকদের ভাবাতে বাধ্য করবে। কিছু ছোটখাটো ত্রুটি থাকলেও, এর বলিষ্ঠ পরিচালনা, অসাধারণ অভিনয় এবং টানটান চিত্রনাট্য এটিকে অবশ্য দ্রষ্টব্য করে তুলেছে। যারা প্রথম ছবিটি পছন্দ করেছিলেন, তারা নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় পর্বেও নিরাশ হবেন না। আমাদের raktabeej 2 bangla movie review অনুযায়ী, এই ছবিটি বাংলা বাণিজ্যিক ছবির জগতে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করার ক্ষমতা রাখে। এটি শুধু বিনোদনই দেয় না, বরং বর্তমান সময়ের কিছু কঠিন বাস্তবকেও সাহসের সাথে তুলে ধরে।

About Author