অযোধ্যার শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্ট গত পাঁচ বছরে সরকারকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিয়েছে—এমন তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই আলোচনা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদ্যুৎ বিল, জিএসটি এবং অন্যান্য করের মাধ্যমে সরকারের তহবিলে জমা হয়েছে। ট্রাস্টের মহাসচিব চম্পত রাই সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে এই তথ্য জানিয়েছেন, যা শুনে অনেকেই অবাক হয়েছেন। এই ঘটনা শুধু ট্রাস্টের আর্থিক স্বচ্ছতাই নয়, অযোধ্যার রাম মন্দিরকে ঘিরে গত কয়েক বছরে বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক গতিশীলতারও প্রমাণ দেয়।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে গেলে দেখা যায়, রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই ট্রাস্ট বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেছে। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে ২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছরের এই সময়কালে নির্মাণ কার্যে ব্যবহৃত উপকরণ, শ্রমিকদের পরিষেবা এবং মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। চম্পত রাই জানিয়েছেন, এই সমস্ত কাজে জিএসটি প্রযোজ্য হয়েছে। যেমন, মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত পাথর, সিমেন্ট, ইস্পাত এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর উপর কর দিতে হয়েছে। এছাড়া, বিদ্যুৎ বিল এবং অন্যান্য পরিষেবার জন্যও ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা সব কিছু স্বচ্ছভাবে করেছি। যা কর দিতে হয়েছে, তা সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।” এই ৪০০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে যোগ হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তারপর থেকে অযোধ্যা ভারতের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম বছরেই প্রায় ১০ কোটির বেশি তীর্থযাত্রী অযোধ্যায় এসেছেন। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ভক্ত রামলালার দর্শনের জন্য ভিড় করছেন। এই বিপুল ভিড়ের কারণে স্থানীয় ব্যবসা, হোটেল, পরিবহন এবং অন্যান্য পরিষেবার চাহিদা বেড়েছে। ফলে ট্রাস্টের আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আয়ের একটি বড় অংশ আসে ভক্তদের দান থেকে। তবে, নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে যে ব্যয় হয়েছে, তার উপর জিএসটি দিতে হয়েছে। চম্পত রাইয়ের মতে, ট্রাস্ট কোনো কর ফাঁকি দেয়নি, বরং নিয়ম মেনে সব ট্যাক্স পরিশোধ করেছে। এই স্বচ্ছতা ট্রাস্টের প্রতি মানুষের ভরসা আরও বাড়িয়েছে।
এই তথ্যের গভীরে গেলে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় সামনে আসে। রাম মন্দির নির্মাণে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশ এসেছে দেশ-বিদেশের ভক্তদের দান থেকে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাটের একজন আধ্যাত্মিক গুরু মোরারি বাপু ব্যক্তিগতভাবে ১১.৩ কোটি টাকা দান করেছেন। এছাড়া তাঁর ভক্তরা বিদেশ থেকে আরও ৮ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত দান হিসেবে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে। এই বিপুল অর্থ নির্মাণে ব্যবহারের পাশাপাশি মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যান্য কাজে লাগছে। তবে, এই ব্যয়ের উপর জিএসটি প্রযোজ্য হওয়ায় ট্রাস্টকে ৪০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়েছে। এটি একটি বড় অঙ্ক, যা দেখায় যে মন্দির শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে নয়, অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এই খবর প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতারা ট্রাস্টের স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশংসা করেছেন। একজন নেতা বলেন, “রাম মন্দির ট্রাস্ট শুধু ধর্মীয় কাজেই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।” তবে, বিরোধী দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে। সমাজবাদী পার্টির এক নেতা বলেন, “যদি ট্রাস্ট এত টাকা ট্যাক্স দিচ্ছে, তবে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে আনা উচিত। এটা জনগণের দানের টাকা, সরকারের নয়।” ধর্মীয় মহলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মন্দিরের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর জিএসটি আরোপ করা উচিত নয়। অন্যদিকে, কেউ কেউ বলছেন, আধুনিক সময়ে কর দেওয়া আইনের অংশ এবং এটি অর্থনীতির জন্য ভালো। এই বিতর্ক স্পষ্ট করে যে রাম মন্দির শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, এর সঙ্গে অর্থনীতি ও রাজনীতিও জড়িয়ে আছে।
অযোধ্যার পরিবর্তনও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মন্দির উদ্বোধনের পর গত পাঁচ বছরে এখানে পর্যটকের সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছে। এসবিআই-এর একটি গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে উত্তরপ্রদেশ সরকার শুধু রাম মন্দির ও অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র থেকে ৫০০০ কোটি টাকা কর সংগ্রহ করতে পারে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আয় বেড়েছে, নতুন হোটেল তৈরি হয়েছে, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। এই অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে রাম মন্দিরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ট্রাস্ট যে ৪০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিয়েছে, তা এই অর্থনৈতিক চক্রেরই একটি অংশ। ভক্তদের দান থেকে আয়, সেই আয় থেকে ব্যয়, আর ব্যয়ের উপর ট্যাক্স—এভাবেই একটি চক্র তৈরি হয়েছে।
সব মিলিয়ে, রাম মন্দির ট্রাস্টের এই ৪০০ কোটি টাকা ট্যাক্স প্রদানের ঘটনা অনেক কিছু বোঝায়। এটি দেখায় যে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে, ট্রাস্টের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার প্রমাণও মেলে। তবে, এই বিষয়ে আলোচনা এখানেই শেষ নয়। সরকার কীভাবে এই অর্থ ব্যবহার করছে, বা ভবিষ্যতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর করের নিয়ম কী হবে—এই প্রশ্নগুলো এখনও খোলা রয়েছে। পাঠক হিসেবে আপনি কী মনে করেন? এই ঘটনা কি শুধু একটি সংবাদ, নাকি এর পেছনে আরও গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে?