কলকাতা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫: ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট জগতের অন্যতম বৃহৎ সংস্থা ফোনপে-কে (PhonePe) ২১ লক্ষ টাকা আর্থিক জরিমানা করল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI)। প্রিপেইড পেমেন্ট ইনস্ট্রুমেন্টস (PPI) সংক্রান্ত নিয়মাবলী লঙ্ঘনের অভিযোগে এই পদক্ষেপ নিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই কোটি কোটি ফোনপে ব্যবহারকারীর মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই জরিমানার ফলে তাদের দৈনন্দিন লেনদেন এবং অন্যান্য পরিষেবা কি प्रभावित হবে?
কেন এই জরিমানা?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়েছে, একাধিকবার নিয়ম লঙ্ঘনের কারণেই ফোনপে-র উপর এই আর্থিক জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। আরবিআই-এর নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুযায়ী, ফোনপে-র মতো সংস্থাগুলিকে তাদের ওয়ালেটে থাকা গ্রাহকদের অর্থের সমপরিমাণ টাকা একটি এসক্রো অ্যাকাউন্টে (Escrow Account) জমা রাখতে হয়। এটি একটি তৃতীয় পক্ষের সুরক্ষিত অ্যাকাউন্ট, যা গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চালানো একটি বিধিবদ্ধ পরিদর্শনে আরবিআই দেখতে পায় যে, বেশ কিছু দিন ফোনপে তাদের এসক্রো অ্যাকাউন্টে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ব্যালেন্স বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ, দিনের শেষে গ্রাহকদের ওয়ালেটে মোট যে পরিমাণ টাকা ছিল এবং ব্যবসায়ীদের যে পরিমাণ টাকা মেটানোর কথা ছিল, তার থেকে কম টাকা এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা ছিল। শুধু তাই নয়, এই ঘাটতির কথা তৎক্ষণাৎ রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানাতেও ব্যর্থ হয় সংস্থাটি।
এই অনিয়ম নজরে আসার পর, পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম অ্যাক্ট, ২০০৭-এর আওতায় ফোনপে-কে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায় আরবিআই। সংস্থার উত্তর এবং শুনানির পর, নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই জরিমানার সিদ্ধান্ত নেয়।
গ্রাহকদের উপর কি কোনও প্রভাব পড়বে?
এই জরিমানার খবরে স্বাভাবিকভাবেই ফোনপে ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং ফোনপে উভয় তরফেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এই ঘটনায় গ্রাহকদের কোনও রকম দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
আরবিআই তার বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই জরিমানা শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রক সম্মতি (Regulatory Compliance) সংক্রান্ত খামতির জন্য আরোপ করা হয়েছে। এর সঙ্গে ফোনপে-র গ্রাহকদের কোনও লেনদেন বা চুক্তির বৈধতার কোনও সম্পর্ক নেই।” অর্থাৎ, গ্রাহকদের টাকা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রয়েছে এবং তারা আগের মতোই ফোনপে-র সমস্ত পরিষেবা ব্যবহার করতে পারবেন। ইউপিআই (UPI) লেনদেন, ওয়ালেট ব্যবহার, বিল পেমেন্ট বা রিচার্জের মতো কোনও পরিষেবাতেই এর কোনও প্রভাব পড়বে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২১ লক্ষ টাকার এই জরিমানা ফোনপে-র মতো একটি বিশাল সংস্থার জন্য আর্থিক দিক থেকে খুব বড় অঙ্ক নয়। তবে, এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়া মনোভাবের পরিচায়ক এবং অন্যান্য ফিনটেক সংস্থাগুলির জন্য একটি সতর্কবার্তা।
ফিনটেক জগতে বাড়ছে আরবিআই-এর নজরদারি
সাম্প্রতিক অতীতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভারতের ক্রমবর্ধমান ফিনটেক (Fintech) সংস্থাগুলির উপর তাদের নজরদারি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কেওয়াইসি (KYC), অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (AML) নিয়ম এবং এসক্রো অ্যাকাউন্টের মতো বিষয়গুলিতে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট সংস্থাকেও জরিমানা করেছে আরবিআই। এই পদক্ষেপগুলি এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, উদ্ভাবন এবং ব্যবসার প্রসারের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করাটা কতটা জরুরি। ফোনপে-র এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করল যে, নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনও রকম শিথিলতা বরদাস্ত করতে রাজি নয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
ফোনপে-র বর্তমান পরিসংখ্যান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জরিমানার খবর এমন এক সময়ে প্রকাশ্যে এল যখন ফোনপে তাদের প্রাথমিক পাবলিক অফারিং বা আইপিও (IPO) আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্তমানে ভারতের ইউপিআই পেমেন্ট বাজারে ফোনপে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংস্থা। ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI)-র সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইউপিআই লেনদেনের প্রায় ৪৭% ফোনপে-র মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কোটি কোটি ব্যবহারকারী প্রতিদিন এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেন করেন।
এই প্রেক্ষাপটে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং সম্মতি বজায় রাখা ফোনপে-র জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জরিমানা সংস্থার ভাবমূর্তির উপর একটি সাময়িক প্রভাব ফেললেও, যেহেতু গ্রাহক পরিষেবা বা তাদের অর্থের সুরক্ষায় কোনও প্রভাব পড়ছে না, তাই দীর্ঘমেয়াদে এর বড় কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
শেষ পর্যন্ত, ফোনপে-র উপর আরবিআই-এর এই ২১ লক্ষ টাকার জরিমানা গ্রাহকদের জন্য কোনও প্রত্যক্ষ উদ্বেগের কারণ নয়। এটি মূলত একটি নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ যা সংস্থা এবং নিয়ন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ব্যবহারকারীরা নিশ্চিন্তে ফোনপে-র পরিষেবা ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারেন। তবে এই ঘটনাটি ডিজিটাল লেনদেনের জগতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ক্রমবর্ধমান সক্রিয় ভূমিকা এবং আর্থিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলির জন্য নিয়ম মেনে চলার অপরিহার্যতার কথাই তুলে ধরছে।











