বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে ধর্মীয় মেরুকরণ এখন একটি জ্বলন্ত বিষয় হয়ে উঠেছে। একদিকে রাজ্যের শাসকদলের উপর মুসলিম তোষণের অভিযোগ উঠছে, অন্যদিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান ঘটছে, যা সমাজে উত্তেজনা ও বিভাজনের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এই দুই প্রবণতা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রকে নতুন রূপ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনা ও পরিসংখ্যানের আলোকে এই বিষয়টি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই ঘটনার শুরু যদি খুঁজতে হয়, তবে গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিকে তাকাতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস, যারা ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠেছে যে তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট নিশ্চিত করতে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য মাসিক ভাতা বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা করেছিল। এই সিদ্ধান্তের পর বিরোধীরা, বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), এটিকে ‘তোষণ নীতি’ বলে কটাক্ষ করে। এর পাশাপাশি, রাজ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে নীরবতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ প্রকল্পের অভিযোগও তৃণমূলের বিরুদ্ধে উঠেছে। অন্যদিকে, বিজেপি ধীরে ধীরে হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে আসছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তাদের আসন সংখ্যা ২ থেকে ১৮-তে পৌঁছানো এই পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিষয়টির গভীরে গেলে দেখা যায়, এই মেরুকরণ শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং সামাজিক স্তরেও এর প্রভাব পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় ২০২৩ সালের রামনবমী উৎসবের সময় হাওড়া ও হুগলিতে সংঘর্ষের ঘটনা। এই সংঘর্ষে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যার জেরে ৫০ জনের বেশি আহত হয় এবং বেশ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর হয়। বিজেপি এই ঘটনাকে ‘মুসলিম তোষণের পরিণাম’ বলে দাবি করলেও, তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে এটি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা উস্কানি। পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, স্থানীয় স্তরে ধর্মীয় শোভাযাত্রা নিয়ে উত্তেজনা থেকেই এই ঘটনা শুরু হয়েছিল। এমন ঘটনা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক তথ্য যোগ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২৭%, যা জাতীয় গড় (১৪.২%) থেকে অনেক বেশি। এই জনসংখ্যার বড় অংশ উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ ও মালদহর মতো জেলায় কেন্দ্রীভূত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই জেলাগুলোতে মুসলিম ভোটারদের সমর্থন তৃণমূলের জয়ের অন্যতম কারণ। তবে, এই নীতির প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, যা বিজেপি কাজে লাগাচ্ছে। ২০২৪ সালের একটি জরিপে (সিএসডিএস) দেখা গেছে, রাজ্যের ৩৫% হিন্দু ভোটার মনে করেন যে তৃণমূল ‘সংখ্যালঘু তোষণে’ বেশি মনোযোগী। এই অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বিজেপি রাম মন্দির, সিএএ-এনআরসি-র মতো ইস্যুতে জোর দিচ্ছে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বাংলার মানুষ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে শাসকদলের নীতি অনেককে খুশি করলেও, অন্যদিকে এটি একটি বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ জন্ম দিচ্ছে। বিজেপি এই ক্ষোভকে হাতিয়ার করে নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে। তবে, এই দুই শক্তির লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের জীবন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। গ্রামে-গঞ্জে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ বাড়ছে, যা আগে এতটা দেখা যেত না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মেরুকরণ যদি না থামে, তবে বাংলার সামাজিক শান্তি বিপন্ন হতে পারে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, এই পরিস্থিতি শুধু রাজনীতির খেলা নয়, বরং সমাজের গভীরে প্রভাব ফেলছে। তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, দুই পক্ষই নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করছে। তৃণমূলের তোষণ নীতি এবং বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদ—দুটোই বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এখন প্রয়োজন সংযম ও সমঝোতার, যাতে রাজ্য আবার তার পুরনো সম্প্রীতির পথে ফিরতে পারে।