গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) “মার্চ টু গোপালগঞ্জ” কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই সংঘটিত সহিংসতায় চারজনের মৃত্যু এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে এই সহিংস পরিস্থিতি তৈরির পেছনে এনসিপির দায় কতটুকু। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নবগঠিত দলটির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা এবং উস্কানিমূলক কৌশল এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
ঘটনার সূত্রপাত এবং পরিণতি
“দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা”র অংশ হিসেবে এনসিপি যখন গোপালগঞ্জের দিকে অভিমুখ করে, তখন থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বুধবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে পৌর পার্কে সমাবেশ শুরুর আগেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকরা মঞ্চে হামলা চালায়। এই হামলায় মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর এবং ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়।
সমাবেশ শেষে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর যখন গোপালগঞ্জ ত্যাগ করার চেষ্টা করে, তখন তাদের উপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়। এই সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪) নিহত হন।
রক্তাক্ত গণতন্ত্র: কোটা আন্দোলনে ৫০ জনের প্রাণহানি, কার কাঁধে বর্তাবে দায়?
এনসিপির দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এনসিপির এই সহিংসতায় প্রাথমিক দায়ভার রয়েছে। তাদের মতে, দলটি তাদের পূর্বের “জুলাই পদযাত্রা” কর্মসূচির নাম হঠাৎ পরিবর্তন করে “মার্চ টু গোপালগঞ্জ” করার মধ্য দিয়ে উস্কানিমূলক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে। “মার্চ টু” শব্দবন্ধটি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং প্রতীকী, যা “মার্চ টু ঢাকা” আন্দোলনের স্মৃতি বহন করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এনসিপির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন। তার মতে, একটি নবীন দল হিসেবে এনসিপির আরো সতর্কতার সাথে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করা উচিত ছিল।
গোপালগঞ্জের বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গোপালগঞ্জ রাজনৈতিকভাবে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা, যেখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সুসংগঠিত উপস্থিতি রয়েছে। অতীতে এই এলাকায় ছাত্রলীগ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সাথেও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এই তথ্যগুলো প্রশাসনের জানার কথা থাকলেও তারা যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এনসিপি জানত যে গোপালগঞ্জে উত্তেজনার সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও তারা এমন ভাষা ও কৌশল গ্রহণ করেছে যা সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির উচিত ছিল স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরো সংযত পদক্ষেপ নেওয়া।
সরকারের ভূমিকা ও তদন্ত কমিটি
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বীকার করেছেন যে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন বড় ধরনের সংঘাতের তথ্য ছিল না। তিনি বলেছেন, “গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, কিন্তু এতো পরিমাণ হবে, সে তথ্য ছিল না”।
সরকার গোপালগঞ্জের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং আইনশৃঙ্খলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, এই ঘটনায় রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবন রক্ষা করার প্রধান দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা মনে করে, সরকার চারজনের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
গোপালগঞ্জে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. পিয়াল লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
উভয় পক্ষের দায়বদ্ধতা
এনসিপি অভিযোগ করেছে যে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকরা পরিকল্পিতভাবে তাদের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন এনসিপির উস্কানিমূলক কৌশল এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন যে এনসিপির কর্মসূচির আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারিত হয়েছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মাজার ভাঙার হুমকির মতো চরম উস্কানিমূলক বক্তব্যও ছিল।
ভোলে বাবার ‘চরণধূলি’তে রক্তের দাগ! হাথরাসে ১২৩ জনের মৃত্যুর পর কী হবে স্বঘোষিত ধর্মগুরুর?
ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রভাব
গোপালগঞ্জের এই সহিংসতা আগামী নির্বাচনের সামনে অশুভ সংকেত হয়ে দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক লাভক্ষতির হিসাবে দেখা যায়, এই ঘটনা এনসিপিকে প্রাথমিকভাবে কিছু সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
এনসিপি এই ঘটনার পর সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে এবং হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য ২৪ ঘন্টা সময় বেঁধে দিয়েছে। এদিকে পুলিশ এ পর্যন্ত সহিংসতার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
গোপালগঞ্জে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে এনসিপির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা এবং উস্কানিমূলক কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে স্থানীয় হামলাকারীদের পরিকল্পিত সহিংসতা এবং প্রশাসনের ব্যর্থতাও এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য সমানভাবে দায়ী। ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সকল রাজনৈতিক দলের আরো দায়িত্বশীল আচরণ এবং সরকারের কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন।