২০২৫ সালের মার্চ মাসে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। ২০০৮ সালে ২৪০ বছরের শাহ রাজবংশের শাসন অবসানের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অভিষিক্ত নেপাল আজ আবার রাজতন্ত্রের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভে সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে, যা দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতার গভীরতা প্রকাশ করে।
“রাজা আসুন, দেশ বাঁচান” – এই স্লোগান নিয়ে রাজতন্ত্র সমর্থকরা রাস্তায় নেমেছে। বিক্ষোভকারীরা জাতীয় পতাকা এবং সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহের ছবি বহন করে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে সরকারকে কারফিউ জারি করতে এবং সেনাবাহিনীকে ডাকতে হয়েছে।
১৭ বছর আগে, ২০০৮ সালের ২৮ মে, নেপাল তার ২৩৯ বছরের হিন্দু রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে ফেডারেল, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ঘোষণা করেছিল। এই পরিবর্তন ১০ বছরের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল, যাতে ১৬,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। কিন্তু গত ১৭ বছরে নেপাল ১৩টি সরকার দেখেছে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রমাণ দেয়।
রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (আরপিপি), যা একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল, এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে, সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ নেপালের গণতন্ত্র দিবসে একটি সম্বোধন দিয়ে নেপালের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন1। তিনি মানুষের কাছে “জাতিকে রক্ষা করতে, জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে এবং সমৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে” সমর্থনের আবেদন জানিয়েছিলেন, প্রজাতান্ত্রিক নেতৃত্বকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ না করার অভিযোগ করেছিলেন।
৯ই মার্চ, হাজার হাজার সমর্থক তাকে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিল, যখন তিনি পশ্চিম নেপাল থেকে ফিরে এসেছিলেন। তারা তাকে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দেখিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসকর্ট করেছিল। এই ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখায় যে নেপালের মানুষের মধ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন কত গভীর।
নেপালের মানুষের মধ্যে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষের কারণ অনেক। দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেকারত্ব, এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনগণকে হতাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, নেপালের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি গত কয়েক বছরে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকৃত জিডিপি ৯% ছিল, যা গত বছর ৫% এর নিচে নেমে এসেছে। মুদ্রাস্ফীতি গত বছর ৪.৬% ছিল।
যুবরাজ ঘিমিরে, দেসনচার.কম এর প্রধান সম্পাদক, যুক্তি দিয়েছেন যে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ভিত্তি তৈরি হয়েছে। “বর্তমান সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দুর্নীতি ও কুশাসনের কারণে জনগণের ক্রমবর্ধমান হতাশা রাজতন্ত্র সমর্থক মনোভাবকে শক্তিশালী করছে,” তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন।
আরপিপি নেতা মিশ্র, রাজতন্ত্র ফেরত আনার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, “একদিকে, নেপাল ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সম্প্রতি রাশিয়ার জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক ফ্ল্যাশপয়েন্ট হয়ে উঠছে। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠান সকল নেপালির জন্য জাতীয় ঐক্যের অনুভূতি নিশ্চিত করবে।”
নেপালের রাজতন্ত্রের ইতিহাস জটিল। শাহ রাজবংশ দু’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে নেপাল শাসন করেছে এবং দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। তবে ২০০৫ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র সরকারকে বরখাস্ত করে সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ১৬ মাস ধরে মৌলিক অধিকার সীমিত করেছিলেন, যার পর ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
নেপালে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় পরিচয়ের সাথেও জড়িত। অনেকেই নেপালকে পুনরায় হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। হিমালমিডিয়া দ্বারা ২০২৪ সালে পরিচালিত একটি জাতীয় সমীক্ষা অনুসারে, প্রায় অর্ধেক মানুষ “দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থা প্রত্যাহার এবং হিন্দু রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা” সমর্থন করেন।
গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৫১ সালে, কিন্তু নেপালের রাজারা দুবার এটি স্থগিত করেছিলেন, ১৯৬০ এবং ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে, দ্বিতীয় জনআন্দোলন রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। ১৮ই মে, পুনর্বহাল প্রতিনিধি সভা নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করে এবং রাজার রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থগিত করে।
বর্তমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ৫০ বছর বয়সী ছুতোর কুলরাজ শ্রেষ্ঠ, যিনি ২০০৬ সালে রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, এখন তার মত পরিবর্তন করে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন। “দেশে সবচেয়ে খারাপ যা ঘটছে তা হল ব্যাপক দুর্নীতি এবং ক্ষমতায় থাকা সব রাজনীতিবিদ দেশের জন্য কিছুই করছে না,” তিনি বলেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিডি ভাট্টা পরিস্থিতিকে পুরানো ও নতুন সামাজিক চুক্তির মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাজতন্ত্র, একক শাসন, এবং হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের অতীতকে সংজ্ঞায়িত করেছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং প্রজাতন্ত্র এর বর্তমানকে আকার দিচ্ছে।
যদিও সাবেক রাজা ফিরে আসার কোন স্পষ্ট ইঙ্গিত দেননি, তিনি দেশের অবস্থা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জীবিকার সন্ধানে যুবকদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন। ৭৭ বছর বয়সী প্রাক্তন মহারাজের চারপাশে নেপালি জনগণের সমর্থন কতটা বৃদ্ধি পাবে এবং এটি রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনে অবদান রাখবে কিনা, তা দেখার বিষয়।