ঝিঙ্গে: স্বাস্থ্যের অমূল্য খনি, জেনে নিন এর উপকারিতা ও অপকারিতা

Ridge gourd health benefits: গ্রীষ্মকাল থেকে বর্ষাকাল জুড়ে বাজারে প্রচুর পরিমাণে ঝিঙ্গে পাওয়া যায়। এই সবজিটি অনেকে খেতে পছন্দ করেন আবার অনেকে এর স্বাদ পছন্দ করেন না। কিন্তু স্বাদের বাইরেও…

Debolina Roy

 

Ridge gourd health benefits: গ্রীষ্মকাল থেকে বর্ষাকাল জুড়ে বাজারে প্রচুর পরিমাণে ঝিঙ্গে পাওয়া যায়। এই সবজিটি অনেকে খেতে পছন্দ করেন আবার অনেকে এর স্বাদ পছন্দ করেন না। কিন্তু স্বাদের বাইরেও ঝিঙ্গের রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা যা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ইংরেজিতে Ridge Gourd নামে পরিচিত এই সবজি বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নামে পরিচিত – হিন্দিতে “তুরাই”, বাংলায় “ঝিঙ্গে”, তেলুগুতে “বিরাকায়া” এবং তামিলে “পিরকাঙ্গাই”। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব ঝিঙ্গের নানান গুণাগুণ, এর উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে।

ঝিঙ্গের পুষ্টিগুণ (Ridge Gourd Nutrition)

ঝিঙ্গে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ একটি সবজি। প্রতি ১০০ গ্রাম ঝিঙ্গেতে কী কী পুষ্টি উপাদান থাকে তা জেনে নেওয়া যাক:

  • জলীয় অংশ: ৯৩ গ্রাম
  • খনিজ পদার্থ: ০.৩ গ্রাম
  • আঁশ (Fiber): ২.৬ গ্রাম
  • খাদ্যশক্তি: ৩০ কিলোক্যালরি
  • আমিষ (Protein): ১.৮ গ্রাম
  • শর্করা (Carbohydrate): ৪.৩ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম: ১৬ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন এ: ৬.৭ মাইক্রোগ্রাম
  • ভিটামিন সি: ৩৩ মিলিগ্রাম

এছাড়াও ঝিঙ্গেতে রয়েছে রিবোফ্ল্যাভিন, জিঙ্ক, লোহা, থায়ামিন ও ম্যাগনেশিয়াম। এতে চর্বি বা কোলেস্টেরল প্রায় নেই বললেই চলে, যা এটিকে একটি স্বাস্থ্যকর সবজি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

খালি পেটে কলা খাওয়া: স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর?

ঝিঙ্গের উপকারিতা (Ridge Gourd Benefits)

ওজন নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ ভূমিকা

ঝিঙ্গে ওজন কমানোর একটি চমৎকার উপায়। এতে ক্যালোরির পরিমাণ খুবই কম এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি1। ঝিঙ্গে খেলে পেট ভরা ভরা লাগে, ফলে বারবার খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়। ঝিঙ্গেতে ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থের পরিমাণ প্রায় নেই বললেই চলে, যা অতিরিক্ত মেদ জমতে দেয় না। এছাড়াও এতে থাকা উপাদানগুলি কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট পরিপাকে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক

ঝিঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। এতে থাকা পেপটাইড এনজাইম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও ঝিঙ্গের ফাইবার ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট নামক উপাদান ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

চোখের স্বাস্থ্যে উপকারী

ঝিঙ্গেতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে বিটা ক্যারোটিন আকারে, যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, পার্শ্বিক অন্ধত্ব এবং অন্যান্য চোখের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বিটা ক্যারোটিন একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা অপটিক স্নায়ু এবং চোখের রক্তনালীগুলি থেকে ক্ষতিকারক টক্সিন দূর করে চোখকে সুরক্ষা দেয়।

রক্তাল্পতা দূর করে

ঝিঙ্গে আয়রনে সমৃদ্ধ, তাই নিয়মিত ঝিঙ্গে খেলে আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও ঝিঙ্গেতে ভিটামিন বি-৬ রয়েছে, যা আয়রনের সাথে মিলে শরীরে লাল রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে। এর ফলে শরীরের সমস্ত অঙ্গে রক্ত প্রবাহ সুষম হয় এবং ক্লান্তি ও ব্যথা কমে।

পাচনতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে

ঝিঙ্গে পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এতে প্রচুর পরিমাণে পানি ও আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ঝিঙ্গের জুস বা রস খাওয়া হলে পেট পরিষ্কারে সাহায্য করে এবং পাইলস রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়াও অ্যাসিডিটি ও আলসার কমাতেও এটি কার্যকর।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

ঝিঙ্গেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এই উপাদানগুলি শরীরকে বিভিন্ন রোগজীবাণু, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।

ত্বকের জন্য উপকারী

ঝিঙ্গেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ফ্রি র্যাডিক্যালকে নষ্ট করে দেয়, এর ফলে ত্বকের স্ট্রেস কমে এবং ত্বক আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এটি রক্ত পরিশোধন করে এবং ত্বকের সংক্রমণ, ব্রণ, কালো দাগ দূর করতে সাহায্য করে, ফলে ত্বক মসৃণ, পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়।

চুলের যত্নে সহায়ক

ঝিঙ্গে হেয়ার ফলিকলে পুষ্টি জোগায়, যার ফলে চুল পড়া বন্ধ হয় এবং চুল ঘন হয়। এছাড়াও নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে, যা চুলের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

হৃদয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে

ঝিঙ্গেতে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রোলাইট রয়েছে যা হৃদয়ের কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই উপাদানগুলি হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ঝিঙ্গেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

লিভারের যত্ন নেয়

ঝিঙ্গে লিভারের জন্য খুবই উপকারী। এটি লিভারে জমা থাকা টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থকে শরীর থেকে বের করে দেয়, যার ফলে লিভার ভালোভাবে কাজ করতে পারে। জন্ডিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ঝিঙ্গে একটি আদর্শ পথ্য। ঝিঙ্গের জুস পান করলে যকৃতের কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং পাইল জুস বা পাচক রস উৎপাদনে সহায়তা করে।

ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে

গরমে ঝিঙ্গে খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়, কারণ এতে ৯৩% পানি রয়েছে যা ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ঝিঙ্গের জুস পান করলে শরীরে হারিয়ে যাওয়া জল ও ইলেক্ট্রোলাইট পুনরায় ভরে দেয়।

হাড়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে

ঝিঙ্গে ম্যাগনেশিয়ামে সমৃদ্ধ, যা হাড়ের জন্য খুবই উপকারী। বয়সের সাথে সাথে হাড়ের অস্টিওপোরোসিস জাতীয় রোগের হাত থেকে বাঁচাতে ঝিঙ্গে খাওয়া উপকারী।

ঝিঙ্গের অপকারিতা (Ridge Gourd Side Effects)

যেকোনো খাবারের মতোই ঝিঙ্গেরও কিছু অপকারিতা রয়েছে যা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।

অ্যালার্জি

ঝিঙ্গে থেকে অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। যাদের ঘন ঘন অ্যালার্জির সমস্যা হয়, তাদের ঝিঙ্গে খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। অ্যালার্জির লক্ষণ হিসেবে ত্বকে লালচে ভাব, চুলকানি, ফুসকুড়ি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

অতিরিক্ত সেবন

যেকোনো খাবারের মতো ঝিঙ্গেও অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে পাচনতন্ত্রে সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত ফাইবার পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।

খাদ্য মিথস্ক্রিয়া

কিছু ওষুধের সাথে ঝিঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করেন। ঝিঙ্গে রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, তাই ডায়াবেটিসের ওষুধের সাথে একসাথে সেবন করলে রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কমে যেতে পারে।

ঝিঙ্গে রান্না করার উপায় (Ridge Gourd Recipes)

ঝিঙ্গে বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া যায়, যেমন:

ঝিঙ্গে দিয়ে ডাল

পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো দিয়ে মসলা কষে তার মধ্যে ছোট ছোট করে কাটা ঝিঙ্গে দিয়ে ডাল রান্না করতে পারেন। এটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর একটি খাবার।

ঝিঙ্গে রাইতা

ঝিঙ্গে সিদ্ধ করে, দই এর সাথে মিশিয়ে রাইতা তৈরি করতে পারেন। এতে সরষে, জিরা, কালো জিরে, হিং, কাঁচা লঙ্কা এবং করিপাতা দিয়ে তেম্পারিং দিতে পারেন।

ঝিঙ্গে ভাজি

ঝিঙ্গে কুচি কুচি করে কেটে নারকেল কোরা, সবুজ লঙ্কা, আদা এবং মসলা দিয়ে ভাজি তৈরি করতে পারেন। এটি চালের সাথে পরিবেশন করা যায়।

ঝিঙ্গে পাকোড়া

ঝিঙ্গে টুকরো করে কেটে বেসন, মসলা দিয়ে তৈরি ব্যাটারে ডুবিয়ে ভেজে পাকোড়া তৈরি করতে পারেন। এটি চা-এর সাথে আদর্শ স্ন্যাকস।

ঝিঙ্গে চাটনি

ঝিঙ্গে, রসুন, লঙ্কা এবং মসলা দিয়ে স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু চাটনি তৈরি করতে পারেন।

কখন ও কিভাবে ঝিঙ্গে খাবেন (When and How to Eat Ridge Gourd)

ঝিঙ্গে গ্রীষ্মকালে এবং বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই সময়গুলিতে শরীরকে ঠান্ডা ও হাইড্রেটেড রাখতে ঝিঙ্গে খাওয়া খুবই উপকারী। সকালের নাস্তায় বা দুপুরের খাবারে ঝিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করলে দিনের বাকি সময় শরীর সতেজ থাকে।

ঝিঙ্গে কেনার সময় লক্ষ্য রাখবেন যে সেগুলি টাটকা, সবুজ এবং নরম হয়। কঠিন ও পুরানো ঝিঙ্গে স্বাদে তেতো হতে পারে।

৭ দিনে চুল লম্বা করার জাদুকরী উপায় – যা আপনাকে অবাক করবে!

ঝিঙ্গের ত্বক ও চুলের যত্নে ব্যবহার (Ridge Gourd for Skin and Hair Care)

ঝিঙ্গের ত্বক ও চুলের যত্নেও অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে।

ত্বকের জন্য

ঝিঙ্গের রস ত্বকে লাগালে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে, ব্রণ কমে এবং ত্বক পরিষ্কার হয়। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ক্ষতি রোধ করে এবং ত্বককে যৌবনসুলভ রাখতে সাহায্য করে।

চুলের জন্য

ঝিঙ্গের রস মাথার ত্বকে লাগালে চুল পড়া কমে এবং চুল ঘন হয়। এছাড়াও ঝিঙ্গের পেস্ট মাথায় লাগিয়ে ধুয়ে ফেললে চুল চকচকে ও নরম হয়।

ঝিঙ্গে একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং বহুমুখী সবজি যা শরীরের নানাবিধ উপকারে আসে। ওজন কমানো থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের সুস্বাস্থ্য, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় – সবই সম্ভব এই সাধারণ সবজি খেলে। তবে, যাদের ঝিঙ্গে থেকে অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা আছে, তাদের এটি এড়িয়ে চলা উচিত। সঠিক পরিমাণে ঝিঙ্গে আমাদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে আমরা এর সমস্ত স্বাস্থ্য উপকারিতা পেতে পারি।

আপনার খাদ্যতালিকায় ঝিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করুন এবং এর অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা উপভোগ করুন। নিয়মিত ঝিঙ্গে খেলে আপনি একটি সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত জীবন যাপন করতে পারবেন। তবে যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যা বা অসুবিধা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।