ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (SEO)-এর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ এতটাই বৈপ্লবিক যে পুরনো অনেক পদ্ধতিই এখন অতীত। ভারতেও এই বদলের ঢেউ এসে পড়েছে এবং বেশ কিছু ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ AI-কে কাজে লাগিয়ে অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছেন। তাঁদের অভিনব কৌশল ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফলে ভারতীয় ব্যবসাগুলি বিশ্ববাজারে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালের ভারতের সেরা ১০ জন AI-এসইও ডিজিটাল মার্কেটারের কথা তুলে ধরব, যাঁরা নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমে এই শিল্পে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছেন।
ডিজিটাল মার্কেটিং-এ AI-এর প্রভাব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনের ফলে এসইও (SEO) এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এর জগৎ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন আর শুধুমাত্র কিওয়ার্ড রিসার্চ বা ব্যাকলিংক তৈরি করাই যথেষ্ট নয়। গ্রাহকদের আচরণ বিশ্লেষণ, ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং কন্টেন্ট অটোমেশনের মতো জটিল কাজগুলি AI-এর সাহায্যে অনেক বেশি সহজ ও কার্যকর হয়ে উঠেছে। এর ফলে মার্কেটাররা আরও সঠিক পূর্বাভাস দিতে এবং ব্যবহারকারীদের আরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (Personalized Experience) প্রদান করতে সক্ষম হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার প্রায় ₹৮৮,০০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, যার একটি বিশাল অংশ AI-চালিত হবে। এই পরিস্থিতিতে যে সমস্ত মার্কেটাররা AI-কে নিজেদের কৌশলের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন, তাঁরাই অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকছেন। নিচে এমন ১০ জন বিশেষজ্ঞের কথা আলোচনা করা হল, যাঁরা AI-ভিত্তিক এসইও-তে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
ভারতের সেরা ১০ জন AI-এসইও ডিজিটাল মার্কেটার (২০২৫)
১. জীতেন্দ্র ভাসওয়ানি:
ডিজিটাল মার্কেটিং জগতে জীতেন্দ্র ভাসওয়ানি একটি অত্যন্ত পরিচিত নাম। তিনি একজন ব্লগার, প্রভাবশালী বক্তা এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই শিল্পে কাজ করছেন। AI-এর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন এবং বর্তমানে AI-চালিত এসইও এবং অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য হন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে AI টুল ব্যবহার করে কিওয়ার্ড রিসার্চ, কন্টেন্ট তৈরি এবং ডেটা অ্যানালাইসিসকে আরও উন্নত করা যায়। তাঁর ব্লগ ‘ব্লগার্স আইডিয়াস’ (BloggersIdeas) নতুন প্রজন্মের মার্কেটারদের কাছে একটি অনুপ্রেরণা।
২. নবনীত প্রাশর:
নবনীত প্রাশর একজন ফলাফল-কেন্দ্রিক এসইও পরামর্শদাতা। তিনি ২৫০টিরও বেশি সংস্থাকে সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পাতায় র্যাঙ্ক করতে সাহায্য করেছেন। AI চ্যাটবট এবং গুগল এআই ওভারভিউতে তাঁর কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা তাঁর দক্ষতাকে প্রমাণ করে। তিনি মূলত ডেটা-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বাসী এবং AI টুল ব্যবহার করে কীভাবে প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে থাকা যায়, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
৩. সৌরভ জৈন:
সৌরভ জৈন ভারতের অন্যতম সফল এবং সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত ডিজিটাল মার্কেটিং পরামর্শদাতাদের মধ্যে একজন। তিনি ‘ডিজিটাল স্কলার’ এবং ‘ইকোভিএমই ডিজিটাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এবং এসইও-তে তাঁর গভীর জ্ঞান রয়েছে। বর্তমানে তিনি AI-কে ব্যবহার করে কীভাবে ব্র্যান্ডের জন্য আরও প্রভাবশালী এবং ব্যক্তিগতকৃত বিপণন কৌশল তৈরি করা যায়, সেই বিষয়ে কাজ করছেন। তাঁর প্রশিক্ষণে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিজিটাল মার্কেটিং-এর জগতে নিজেদের কর্মজীবন শুরু করেছে।
৪. দীপক কনকরাজু (ডিজিটাল দীপক):
‘ডিজিটাল দীপক’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। দীপক কনকরাজু ভারতের ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষণের জগতে এক অন্যতম জনপ্রিয় নাম। তিনি AI-ভিত্তিক মার্কেটিং ফানেল এবং অটোমেশন বিশেষজ্ঞ। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে AI ব্যবহার করে গ্রাহকদের আচরণ বোঝা যায় এবং সেই অনুযায়ী মার্কেটিং কৌশল তৈরি করে বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো যায়। তাঁর অনলাইন কোর্স এবং ব্লগ লক্ষ লক্ষ মানুষকে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখতে সাহায্য করেছে।
৫. আমনপ্রীত সিং:
গত এক দশকে অর্গানিক লিড জেনারেশনের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের জন্য ১০ লক্ষ ডলারেরও বেশি রাজস্ব আয় করে দিয়েছেন আমনপ্রীত সিং। তিনি মূলত সিম্যান্টিক এসইও (Semantic SEO) এবং ব্যবহারকারী-কেন্দ্রিক কন্টেন্ট তৈরির উপর জোর দেন। তাঁর মতে, AI শুধুমাত্র প্রক্রিয়াকে সহজ করে না, বরং মানুষের মতো করে চিন্তাভাবনা করে কন্টেন্ট তৈরি করতেও সাহায্য করে, যা গুগলের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান।
৬. হর্ষ আগরওয়াল:
‘শাউটমিলউড’ (ShoutMeLoud) ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হর্ষ আগরওয়াল ভারতীয় ব্লগার এবং ডিজিটাল মার্কেটারদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি প্রথম থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে আপডেট রেখেছেন। বর্তমানে তিনি তাঁর ব্লগে AI-এর ব্যবহার এবং এসইও-তে এর প্রভাব নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, AI মার্কেটারদের আরও সৃজনশীল হতে সাহায্য করে এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ থেকে মুক্তি দেয়।
৭. বৈভব সিসিন্তি:
গ্রোথ হ্যাকিং এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এ বৈভব সিসিন্তি এক নতুন প্রজন্মের মুখ। তিনি খুব অল্প সময়েই নিজের দক্ষতার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি মূলত স্টার্টআপদের জন্য কম খরচে কীভাবে AI ব্যবহার করে দ্রুত বৃদ্ধি করা যায়, সেই বিষয়ে পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, AI ছোট সংস্থাগুলির জন্য একটি বড় সুযোগ, কারণ এটি তাদের বড় সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য সমান ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।
৮. শান্তা নারাং:
বিটুবি (B2B), বিটুসি (B2C), এবং ডিটুসি (D2C) সব ধরনের ব্যবসার জন্যই শান্তা নারাং একজন অভিজ্ঞ ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ। তিনি কন্টেন্ট মার্কেটিং এবং এসইও-তে AI-এর প্রয়োগ নিয়ে কাজ করেন। তাঁর মতে, AI-এর সাহায্যে কন্টেন্টের মান উন্নত করা এবং সঠিক দর্শকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়েছে। তিনি বিভিন্ন সংস্থাকে তাদের কন্টেন্ট কৌশলকে AI-এর সঙ্গে যুক্ত করতে সাহায্য করছেন।
৯. মণীশ চৌহান:
প্রায় ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মণীশ চৌহান বর্তমানে ‘গ্রো’ (Groww)-এর এসইও বিভাগের প্রধান। তিনি ডেটা-চালিত পদ্ধতির মাধ্যমে অর্গানিক ট্র্যাফিক বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশ্বাস করেন যে, AI এবং মেশিন লার্নিং এসইও-র ভবিষ্যৎ এবং এর সঠিক ব্যবহার সার্চ ইঞ্জিন র্যাঙ্কিং-এ দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য এনে দিতে পারে।
১০. প্রণব ঝা:
‘এপি ওয়েব ওয়ার্ল্ড’ (AP Web World)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রণব ঝা একজন গুগল পার্টনার এজেন্সির কর্ণধার। তিনি ছোট এবং মাঝারি ব্যবসাগুলিকে ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশল তৈরিতে সাহায্য করেন। তিনি AI-চালিত এসইও টুল ব্যবহার করে ক্লায়েন্টদের জন্য দুর্দান্ত ফলাফল এনে দিয়েছেন। তাঁর মতে, লোকাল এসইও (Local SEO)-তে AI-এর ব্যবহার আগামী দিনে আরও বাড়বে এবং স্থানীয় ব্যবসাগুলি এর থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
ডিজিটাল মার্কেটিং-এর ভবিষ্যৎ যে AI-নির্ভর হতে চলেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে মার্কেটার বা সংস্থা যত দ্রুত এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারবে, তারা ততটাই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। উপরে উল্লিখিত বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই সেই পথে হেঁটেছেন এবং অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। তাঁদের কাজ শুধুমাত্র কয়েকটি সংস্থাকে সাহায্য করছে না, বরং সমগ্র ভারতীয় ডিজিটাল মার্কেটিং শিল্পকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছে। আগামী দিনে এই ক্ষেত্রে আরও নতুন প্রতিভা উঠে আসবে এবং ভারতকে ডিজিটাল দুনিয়ায় এক শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।