রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা (এবিপিএস) এর বার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বেঙ্গালুরুতে ২১-২৩ মার্চ, ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আরএসএস ভারত সরকারকে এই বিষয়ে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছে।
আরএসএস-এর সহ সর্কারিয়াবাহ অরুণ কুমার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অবিরাম এবং পরিকল্পিত সহিংসতা, অন্যায় ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৫১ সালে যেখানে ২২% ছিল, সেখানে বর্তমানে তা মাত্র ৭.৯৫% এ নেমে এসেছে, যা এই সঙ্কটের তীব্রতাকে প্রতিফলিত করে1112।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় মঠ, মন্দির, দুর্গাপূজা পন্ডেল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হামলা, মূর্তি অপবিত্রকরণ, নৃশংস হত্যা, সম্পত্তি লুঠ, মহিলাদের অপহরণ ও নির্যাতন এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনা অব্যাহত থাকার বিষয়টি আরএসএস-এর প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরএসএস এই ঘটনাগুলিকে “রাজনৈতিক” হিসেবে খারিজ করে ধর্মীয় চরিত্র উপেক্ষা করাকে সত্যের বিকৃতি বলে অভিহিত করেছে, কারণ বেশিরভাগ শিকার হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
এবিপিএস প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি, বিশেষ করে পাকিস্তান এবং “ডিপ স্টেট” সমগ্র অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে2। আরএসএস অভিযোগ করেছে যে এই শক্তিগুলি বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে, যা নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।
উল্লেখ্য যে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মুখে পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আছে, যিনি এই ধরনের সহিংসতার ঘটনাগুলিকে “অতিরঞ্জিত প্রপাগান্ডা” হিসেবে বারবার বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ইউনুসের দাবিকে খন্ডন করেছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী গোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক জনতা হামলার প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্যভাবে, এই অনুসন্ধান দল ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণেই প্রেরণ করা হয়েছিল।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, “থাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, এবং দিনাজপুরের মতো গ্রামীণ ও ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ এলাকায়, এবং সিলেট, খুলনা, ও রংপুরের মতো অন্যান্য স্থানেও হিন্দু বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়ে ব্যাপক হামলার খবর পাওয়া গেছে”। এছাড়া, “বুড়াশারদুবি, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাটে তিনটি মন্দিরে হামলা করা হয় এবং আগুন লাগানো হয়, সাথে প্রায় ২০টি বাড়ি লুট করা হয়”।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের প্রথম ১০০ দিনে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুরা ২,০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, আরএসএস জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক আচরণ সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে নোট নিতে এবং বাংলাদেশ সরকারকে এই সহিংস কার্যকলাপ বন্ধ করতে চাপ দিতে। আরএসএস বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য বিশ্বব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য যে সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফর করেছেন (মার্চ ২০২৫) এবং দেশটি যে “মৌলিক মুহূর্ত” অতিক্রম করছে তা তুলে ধরেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসের সাথে সাক্ষাৎ করে গুতেরেস বলেছেন, “দেশটি যখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, বিশ্বাস ও নিরাময় প্রচারে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে”।
বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে, যেখানে সম্প্রতি গঠিত জাতীয় নাগরিক দল (এনসিপি) সামরিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে3। এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “যাদের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে কাজ করার কথা, তাদের সেখানেই থাকা উচিত। ‘বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে’ রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোন হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না।
এদিকে, সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন যে অন্তর্বর্তী সরকার জনসাধারণের নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বর্তমান অস্থিরতার কারণে এই বছর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কঠিন হবে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে আরএসএস-এর উদ্বেগ প্রকাশ ও ভারত সরকারের হস্তক্ষেপের আহ্বান বিশেষ তাৎপর্য রাখে, যেখানে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক ইতিমধ্যেই শেখ হাসিনার পতনের পর চাপের মুখে রয়েছে। ভারত সরকার অবশ্য এখনো এই বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।