ভারতীয় সমাজে গুজব একটি চিরন্তন সমস্যা। বর্তমান ডিজিটাল যুগে এর প্রসার ও প্রভাব আরও বেড়েছে। সামাজিক সংহতি ও শান্তি বজায় রাখতে এর মোকাবেলা অত্যন্ত জরুরি।
গুজব হলো এমন একটি অযাচিত তথ্য যার সত্যতা যাচাই করা হয়নি কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গুজব রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া গুজব ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম। ভারতে ২০২৩ সালের হিসাবে ৪৬.৫ কোটিরও বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী রয়েছে। এর মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক সর্বাধিক জনপ্রিয়। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৮.৭ কোটি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
গুজবের সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। ২০১৮ সালে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া শিশু অপহরণের গুজবে অন্তত ৩৩ জন নিরীহ ব্যক্তি খুন হন। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ (Covid 19) মহামারী সংক্রান্ত গুজবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে।
গুজবের কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পেছনে গুজবের ভূমিকা ছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর প্রভাব গুরুতর। ২০১৬ সালে নোটবাতিলের সময় গুজবের কারণে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়।
গুজব মোকাবেলায় ভারত সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে নতুন নীতিমালা চালু করে। এতে প্ল্যাটফর্মগুলোকে মিথ্যা তথ্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারগুলোও বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। উত্তরপ্রদেশ সরকার ২০২০ সালে গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাস করে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (PIB) নিয়মিত ফ্যাক্ট চেক করে গুজব প্রতিরোধে কাজ করছে। ২০২০ সালে MyGov ইন্ডিয়া একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটবট চালু করে যা গুজব সনাক্ত ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গণমাধ্যমের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য নৈতিকতার নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। এতে গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রচার না করার নির্দেশনা রয়েছে। বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম নিজস্ব ফ্যাক্ট-চেকিং বিভাগ চালু করেছে।
নাগরিক সমাজের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন দেশের প্রায় ৯০০টি কলেজে “ভোটার সচেতনতা ফোরাম” গঠন করে। এর মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে গুজব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হয়। বুম লাইভ, অল্ট নিউজ-এর মতো বেসরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত ফ্যাক্ট-চেকিং করে গুজব প্রতিরোধে কাজ করছে।
তবে শুধু আইনি পদক্ষেপ বা সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন। তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সমালোচনামূলক চিন্তার উপর জোর দিতে হবে।
গুজব প্রতিরোধে সরকার, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও প্রতিটি ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তথ্যের যুগে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে পারাটাই হবে প্রকৃত শিক্ষা ও সভ্যতার পরিচয়।
মন্তব্য করুন