ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ২০২৫ সালে এসে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধ সমাধানের লক্ষ্যে এক নতুন অভিমুখ গ্রহণ করেছে, যেখানে বর্তমান সীমারেখায় যুদ্ধবিরতি এবং রাশিয়ার অনেক দাবি মেনে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন পূর্ববর্তী বাইডেন প্রশাসনের কৌশল থেকে একটি উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি প্রতিনিধিত্ব করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন ডাইনামিকস সৃষ্টি করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক কৌশলগত উদ্দেশ্য
ইউক্রেন সংঘাতের শুরু থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত লক্ষ্যগুলি ছিল সুস্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল:
-
ইউক্রেনকে নিজেকে রক্ষা করার সক্ষমতা প্রদান এবং রাশিয়ার কৌশলগত সাফল্য প্রতিরোধ করা
-
ভবিষ্যতে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধ করা
-
রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা NATO-এর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো
-
একটি গণতান্ত্রিক, স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সমৃদ্ধ ইউক্রেন গড়ে তোলা
জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি আরও স্পষ্টভাবে চারটি কৌশলগত উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছিলেন:
-
মার্কিন সেনাবাহিনী এবং NATO-র সাথে রাশিয়ার মধ্যে কোনো সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো
-
যুদ্ধকে ইউক্রেনের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা
-
NATO-র ঐক্য বজায় রাখা
-
ইউক্রেনকে শক্তিশালী করা এবং লড়াইয়ের জন্য উপায় দেওয়া
বাস্তবায়ন কৌশল: উপায় এবং সাধন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদান প্রয়োগ করেছে – কূটনৈতিক, তথ্য, অর্থনৈতিক এবং সামরিক। মূল কৌশলগত উপায়গুলি ছিল:
-
ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান
-
ইউক্রেনের জন্য আন্তর্জাতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন জোগাড় করা
-
রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা
-
মিত্রদের আশ্বাস দেওয়া এবং আরও রাশিয়ান আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্য বাহিনী মোতায়েন করা
মার্কিন সহায়তার পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৫ সালের শুরুতে, ইউক্রেন যে সমস্ত সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছিল তার ২০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছিল, ২৫% ইউরোপ থেকে, এবং ৫৫% ইউক্রেন নিজেই উৎপাদন করেছিল। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ম্যালকম চ্যালমার্সের মতে, আমেরিকার দেওয়া ২০% “সবচেয়ে ঘাতক এবং গুরুত্বপূর্ণ”।
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে কৌশলগত পরিবর্তন
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর, মার্কিন কৌশলে একটি তীক্ষ্ণ পরিবর্তন এসেছে। নির্বাচনী প্রচারের সময়, ট্রাম্প মার্কিন সামরিক সাহায্যের সমালোচনা করেছিলেন এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান পদক্ষেপগুলি:
-
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান
-
ইউক্রেনের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইউরোপের উপর চাপিয়ে দেওয়া
-
ইউক্রেনের জন্য NATO সদস্যপদ সম্ভাবনা খাটো করা
-
২০১৪ সালের আগের সীমানা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে অবাস্তব হিসেবে চিহ্নিত করা, যা অনেক ইউরোপীয় দেশ মস্কোর প্রতি বড় ছাড় হিসেবে দেখে
প্রশাসন কখনও কখনও রাশিয়ার অবস্থানের প্রতিধ্বনি করেছে, ট্রাম্প ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে একনায়ক বলে আখ্যায়িত করেছেন (যদিও পরে তিনি এই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন) এবং ইউক্রেনে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বর্তমান শান্তি প্রস্তাব এবং আলোচনা
২০২৫ সালের এপ্রিলে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইউক্রেনকে এমন একটি মার্কিন শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন যা রাশিয়ার দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্যগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
-
তিন বছরের সংঘাতে বর্তমান ফ্রন্ট লাইন বরাবর ভূখণ্ডীয় সীমানা “ফ্রিজ” করা
-
ক্রিমিয়ার রাশিয়ান বাহিনীর অধিগ্রহণ স্বীকার করা
-
ইউক্রেনের NATO-তে যোগদানকে বাধা দেওয়া2
ভ্যান্স জানিয়েছেন যে প্রস্তাবিত আমেরিকান পরিকল্পনার অধীনে, “আমরা ভূখণ্ডের রেখাগুলিকে তাদের বর্তমান অবস্থানের কাছাকাছি একটি স্তরে ফ্রিজ করতে যাচ্ছি।” তিনি আরও যোগ করেন, “বিদ্যমান লাইন, বা অনুরূপ কিছু, এটাই হল যেখানে আমি বিশ্বাস করি সংঘর্ষে নতুন সীমারেখা অবশেষে আঁকা হবে।”
এই প্রস্তাবে থাকা বিষয়গুলি:
-
অবিলম্বে, শর্তহীন ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি
-
পরবর্তীতে যুদ্ধের স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা
বর্তমানে, কূটনৈতিক উদ্যোগগুলি ত্বরান্বিত হচ্ছে। লন্ডনে আলোচনা চলছে, যাতে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইউক্রেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে তার চতুর্থ আলোচনার জন্য মস্কো যাচ্ছেন।
৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি এবং সাহায্য পুনরায় আরম্ভের প্রস্তাব
মার্চ ২০২৫ সালে, সৌদি আরবের জেদ্দায় আলোচনার পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন “অবিলম্বে, অন্তর্বর্তী ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি” তে সম্মত হয়েছে, যা বাড়ানো যেতে পারে তবে প্রথমে রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে।
এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক ও গোয়েন্দা সাহায্য পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়েছে। আলোচনার পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ক্রেমলিন সম্পর্কে বলেছেন, “বল এখন তাদের কোর্টে”।
অবশেষে ইউক্রেন আমেরিকার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে। ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে জেলেনস্কির দেশ। ইউক্রেনের তরফে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির কথা জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে যুদ্ধের অবসানের জন্য আলোচনা শুরু করতেও রাজি হয়েছে ইউক্রেন।
সাতদফা প্রস্তাব এবং এর প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইউক্রেনকে যুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি সাত-দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, যাতে:
-
ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া
-
রাশিয়ান বাহিনীকে দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে রাখতে দেওয়া
-
ইউক্রেনের NATO-তে যোগদান না করার প্রতিশ্রুতি
-
জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে “ইউক্রেনীয় অঞ্চল” হিসেবে বিবেচনা করা, তবে মার্কিন পরিচালনাধীন থাকবে
-
নির্দিষ্ট প্রদেশে রাশিয়ান বাহিনী প্রত্যাহার
-
ইউক্রেন-মার্কিন খনিজ চুক্তি
-
মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ক উন্নতি
এই প্রস্তাবিত পরিকল্পনা ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেকে চিন্তিত যে ওয়াশিংটন এবং মস্কো ইউক্রেনের ভাগ্য কিয়েভ বা তার ইউরোপীয় মিত্রদের ছাড়াই আলোচনা করতে পারে। বিশ্লেষকরা ১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপকে প্রভাব বলয়ে বিভক্ত করেছিল।
সামরিক সাহায্য এবং আর্থিক সমর্থন
মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত, পশ্চিমা সরকারগুলি ইউক্রেনকে আক্রমণের পর থেকে ৩৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ১১৮ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি সামরিক সাহায্য।
ইউরোপীয় দেশগুলি ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ১৩২ বিলিয়ন ইউরো সাহায্য (সামরিক, আর্থিক এবং মানবিক) প্রদান করেছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১১৪ বিলিয়ন ইউরো প্রদান করেছে। মার্কিন অর্থায়নের বেশিরভাগ আমেরিকান শিল্পকে সমর্থন করে যারা অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করে।
এই সাহায্য সত্ত্বেও, বৃদ্ধির আশঙ্কায় NATO দেশগুলি ইউক্রেনকে ভারী এবং আরও উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করতে দ্বিধা করেছে, বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে যেমন ইউক্রেনকে রাশিয়ার ভিতরে আঘাত হানতে নিষেধ করা। জুন ২০২৪ থেকে, তারা এই নিষেধাজ্ঞাগুলির কিছু তুলে নিয়েছে, ইউক্রেনকে আত্মরক্ষায় সীমান্তের কাছে রাশিয়ান সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে অনুমতি দিয়েছে।
মার্কিন কৌশলের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বর্তমান পরিস্থিতিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্টতই ইউক্রেনের জন্য আমেরিকার দীর্ঘকালীন প্রতিশ্রুতিকে পুনর্মূল্যায়ন করছে এবং পূর্ববর্তী প্রশাসন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নীতিগত লক্ষ্যগুলি থেকে সরে আসছে।
সাম্প্রতিক গতিবিধি ইঙ্গিত করে যে:
-
আমেরিকা এখন ইউক্রেনে একটি দ্রুত সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, এমনকি যদি তা ইউক্রেনের ভূখণ্ডীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়ে বিশাল ছাড় প্রদানের অর্থ বহন করে
-
ইউক্রেনের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইউরোপীয় দেশগুলির দিকে স্থানান্তর করা হচ্ছে
-
রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নরমালাইজেশনের একটি বৃহত্তর অভিযান চলছে
-
শান্তির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলি গতি পাচ্ছে, যদিও ইউক্রেন এবং পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে যে আমেরিকা ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় স্বার্থকে বিপণন করতে পারে
উপসংহার
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে মার্কিন কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে, আমেরিকা তার প্রাথমিক বিষয়কে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে – সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো, একটি সমাধানের দিকে ত্বরিত অগ্রগতি, এবং ইউরোপে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি কমানো।
বর্তমান প্রস্তাবিত ৩০-দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব, সাত-দফা শান্তি পরিকল্পনা, এবং বর্তমান ফ্রন্ট লাইনে ভূখণ্ডীয় সীমানা ‘ফ্রিজ’ করার পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধ সমাপ্ত করতে এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নরমালাইজ করতে আগ্রহী, এমনকি যদি তা ইউক্রেনীয় আকাঙ্ক্ষার সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়।
এই নীতিগত পরিবর্তন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় নেতৃত্বের মধ্যে, যারা ইউক্রেনের স্থিতিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। আগামী মাসগুলি দেখাবে এই কৌশলগত পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত একটি স্থায়ী সমাধান আনতে পারে কিনা, নাকি এটি কেবল সংঘাতের একটি নতুন পর্যায়কে সূচিত করে।