ভারতের বিদেশমন্ত্রী ডঃ এস জয়শঙ্কর আগামী ১৫-১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য পাকিস্তান সফর করবেন বলে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এটি হবে গত প্রায় এক দশকের মধ্যে কোনো ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর প্রথম পাকিস্তান সফর।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, “বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ১৫ ও ১৬ অক্টোবর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় SCO সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন।” তবে তিনি এই সফরে পাকিস্তানি নেতাদের সাথে কোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি।
এই সফর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির ইঙ্গিত বহন করছে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতির দিকে যায়। তবে SCO-এর মতো আঞ্চলিক সংগঠনের মাধ্যমে দুই দেশ যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে।
IND vs PAK Highlights: ঐতিহাসিক জয়ের পর এশিয়া কাপে নতুন রেকর্ড গড়লেন হরমনপ্রীতরা
গত মে মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত SCO বৈদেশিক মন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ১২ বছরের মধ্যে কোনো পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর।
SCO হল একটি আন্তঃসরকারি সংগঠন যার সদস্য দেশগুলো হল – ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান। এটি ইউরেশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত।
জয়শঙ্করের এই সফর নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ ও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার টি.সি.এ. রাঘবন বলেছেন, “আমাদের ভারত-পাকিস্তান ইস্যুকে অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হতে দেওয়া উচিত নয়। SCO ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক মতভেদকে সেই মূল্যবোধকে ছাপিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয়।”
অতীতে ভারতের বিদেশমন্ত্রীদের পাকিস্তান সফরের ইতিহাস:
– ২০১৫: সুষমা স্বরাজ
– ২০১২: এস.এম. কৃষ্ণ
– ২০১১: এস.এম. কৃষ্ণ
– ২০১০: এস.এম. কৃষ্ণ
– ২০০৮: প্রণব মুখার্জি
– ২০০৭: প্রণব মুখার্জি
– ২০০৬: প্রণব মুখার্জি
– ২০০৫: নটওয়ার সিং
– ২০০৪: নটওয়ার সিং
– ২০০৩: যশবন্ত সিনহা
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের পর থেকে কোনো ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী পাকিস্তান সফর করেননি। সুতরাং জয়শঙ্করের এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
জয়শঙ্কর সম্প্রতি বলেছেন, “পাকিস্তানের সাথে অবিরাম আলোচনার যুগ শেষ হয়েছে। কর্মের পরিণতি আছে।” তিনি আরও বলেন, “জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে গেছে।” এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়।
তবে তিনি এও বলেছেন, “আমরা নিষ্ক্রিয় নই। ঘটনাপ্রবাহ ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেদিকেই যাক, আমরা সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাব।” এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নতির জন্য ভারত প্রস্তুত, যদি পাকিস্তান ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়।
SCO সম্মেলনে জয়শঙ্করের অংশগ্রহণ নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এখনও জানা যায়নি। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “আমরা SCO সম্মেলনে ভারতের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানাই। এটি আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।”
ভারত G-7 এর সদস্য নয়, তা সত্ত্বেও কেন বারবার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, SCO সম্মেলনে জয়শঙ্করের অংশগ্রহণ দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের একটি নতুন চ্যানেল খুলে দিতে পারে। তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য উভয় দেশকেই আরও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।
ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার গৌতম বাম্বাওয়ালে বলেছেন, “SCO ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারকে স্পষ্ট করে দিতে হবে যে, এই সফর শুধুমাত্র SCO-এর জন্য এবং পাকিস্তানের সাথে কোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে না।”
জয়শঙ্করের এই সফর SAARC সম্মেলনের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের নীতির সাথে স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখাচ্ছে। ২০১৬ সালের আগস্টে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং SAARC স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর থেকে কোনো ভারতীয় মন্ত্রী পাকিস্তানে কোনো বহুপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দেননি।
২০১৬ সালে পাঠানকোট বিমানঘাঁটি ও উরি সেনা ছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানে SAARC সম্মেলন বর্জন করে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত কোনো SAARC বৈঠকে যোগ দেয়নি।
SCO সম্মেলনে জয়শঙ্করের অংশগ্রহণ নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক মহলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেস নেতা শশি থারুর বলেছেন, “পাকিস্তানের সাথে কথা বলা উচিত, কিন্তু সেটা করতে হবে সতর্কতার সাথে। আমাদের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
অন্যদিকে, বিজেপি নেতা সুব্রমণিয়াম স্বামী বলেছেন, “SCO একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সংগঠন। এতে অংশগ্রহণ করা ভারতের স্বার্থে। তবে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করার সময় এখনও আসেনি।”
সামগ্রিকভাবে, জয়শঙ্করের এই সফর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তবে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে আরও অনেক সময় লাগবে।