বায়ুশক্তির মাধ্যমে নতুন যুগের কার্গো জাহাজ চালানোর উদ্যোগ।

বাণিজ্য জগতে এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। প্রাচীন কালের পালতোলা জাহাজের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে বায়ুশক্তি চালিত বিশাল কার্গো জাহাজ এখন বাস্তবতায় পরিণত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি চীন থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে…

Avatar

 

বাণিজ্য জগতে এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। প্রাচীন কালের পালতোলা জাহাজের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে বায়ুশক্তি চালিত বিশাল কার্গো জাহাজ এখন বাস্তবতায় পরিণত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি চীন থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে পিক্সিস ওশান (Pyxis Ocean) নামের একটি কার্গো জাহাজ, যা বিশেষভাবে ডিজাইন করা “উইন্ড উইংস” (Wind-Wings) নামক দুটি বিশাল পাল দিয়ে সজ্জিত।
এই অভিনব প্রযুক্তি শিপিং শিল্পে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কারগিল (Cargill) নামক একটি বড় শিপিং চার্টারার কোম্পানি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তাদের লক্ষ্য হলো জাহাজের জ্বালানি ব্যবহার ও কার্বন নির্গমন কমানো।
পটভূমি ও প্রাসঙ্গিকতা
আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্প বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের প্রায় ২.১% এর জন্য দায়ী। এই খাতে বছরে প্রায় ৮৩৭ মিলিয়ন টন CO2 নির্গত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় এই শিল্পকে দ্রুত কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। এই লক্ষ্যে বায়ুশক্তির ব্যবহার একটি আশাব্যঞ্জক সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রযুক্তিগত বিবরণ
পিক্সিস ওশান জাহাজটিতে দুটি বিশেষ ধরনের পাল লাগানো হয়েছে যাকে “উইন্ড উইংস” বলা হচ্ছে। এই পালগুলো উচ্চতায় ১২৩ ফুট (৩৭.৫ মিটার) পর্যন্ত লম্বা। বন্দরে থাকার সময় এগুলো ভাঁজ করে রাখা যায়, আর খোলা সমুদ্রে পৌঁছালে খুলে দেওয়া হয়। এই পালগুলো উইন্ড টারবাইন ব্লেডের মতো একই উপাদান দিয়ে তৈরি, যা এগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী করে। বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরতা কমে যায়।

সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল

কারগিল কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নতুন কার্গো জাহাজের জীবনকালে গড়ে ৩০% পর্যন্ত কার্বন নির্গমন কমানো যেতে পারে। এটি প্রতিদিন গড়ে ৩ টন জ্বালানি সাশ্রয় করতে পারে, যা বছরে প্রায় ৪৮০টি গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সমতুল্য। বার টেকনোলজিস (BAR Technologies) নামক যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠান এই উইন্ড উইংস প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তারা আশা করছে ভবিষ্যতে তিনটি উইং ব্যবহার করে আরও বেশি জ্বালানি ও নির্গমন কমানো যাবে।

পরিসংখ্যান ও তথ্য

  • আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্প বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের প্রায় ২.১% এর জন্য দায়ী।
  • এই খাতে বছরে প্রায় ৮৩৭ মিলিয়ন টন CO2 নির্গত হয়।
  • উইন্ড উইংস প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নতুন কার্গো জাহাজের জীবনকালে গড়ে ৩০% পর্যন্ত কার্বন নির্গমন কমানো যেতে পারে।
  • এই প্রযুক্তি প্রতিদিন গড়ে ৩ টন জ্বালানি সাশ্রয় করতে পারে।
  • বিশ্বব্যাপী মোট ১১৪,০০০ জাহাজের মধ্যে মাত্র ১০০টিতে বায়ুশক্তি সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের টিনডাল সেন্টারের ড. সাইমন বুলক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শিপিং শিল্পকে দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এই অপরিহার্য প্রযুক্তিগুলো সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবং এগুলো স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহার ও রেট্রোফিট করা উচিত।”
কারগিল ওশান ট্রান্সপোর্টেশনের প্রেসিডেন্ট জান ডিলেম্যান বলেন, “শিপিং শিল্প কার্বন নির্গমন কমানোর একটি যাত্রায় রয়েছে – এটি সহজ নয়, কিন্তু এটি উত্তেজনাপূর্ণ। পাঁচ-ছয় বছর আগে যদি আপনি শিপিং শিল্পের লোকদের কার্বন নির্গমন কমানো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, তারা বলত এটা খুব কঠিন, আমি এটা শীঘ্রই ঘটতে দেখছি না। পাঁচ বছর পর, আমি মনে করি বর্ণনা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রত্যেকেই এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তাদের নিজেদের অংশ করতে হবে।”

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

তবে এই প্রযুক্তি সব ধরনের জাহাজের জন্য উপযোগী নয়। যেমন, বড় কন্টেইনার বহনকারী জাহাজে এই পাল লাগানো সম্ভব নয়। এছাড়া অনেক বন্দর এখনও এই ধরনের জাহাজ গ্রহণে অনিচ্ছুক, কারণ এটি তাদের কাছে নতুন।এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিপিং কোম্পানিগুলো বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছে। কারগিল বিশ্বব্যাপী ২৫০টিরও বেশি বন্দরের সাথে যোগাযোগ করছে যাতে এই ধরনের জাহাজ সহজে ডক করতে পারে।
বায়ুশক্তি চালিত কার্গো জাহাজ শিপিং শিল্পে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এটি জ্বালানি খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে শিল্প ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর। আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরে এই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং এটি শিপিং শিল্পকে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করে তুলবে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম