আপনার মুখের ভিতর হঠাৎ করে ব্যথা হচ্ছে? খাবার খাওয়ার সময় গাল বা চিবুকের নিচে ফোলাভাব দেখা দিচ্ছে? তাহলে হতে পারে আপনার লালা গ্রন্থির পাথর হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি ‘সিয়ালোলিথিয়াসিস’ নামে পরিচিত । এই সমস্যা দেখা দিলে লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায় জানা অত্যন্ত জরুরি। আজকের আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো কীভাবে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
লালা গ্রন্থি আমাদের মুখের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা খাবার হজমে সাহায্য করে। কিন্তু কখনো কখনো এই গ্রন্থিতে পাথর জমে যায়, যা লালার প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে । গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৮০ শতাংশ সিয়ালোলিথিয়াসিস সাবমান্ডিবুলার গ্রন্থিতে হয়ে থাকে ।
লালা গ্রন্থির পাথর কী এবং কেন হয়?
লালা গ্রন্থির পাথর মূলত ক্যালসিয়াম ফসফেট এবং ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্ফটিক, যা লালা গ্রন্থির নালীতে জমে শক্ত পিণ্ড তৈরি করে । এই পাথরের আকার কয়েক মিলিমিটার থেকে শুরু করে ২-৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
পাথর সৃষ্টির কারণসমূহ:
-
পানি কম খাওয়ার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা
-
ধূমপান করার অভ্যাস
-
নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সেবন, যেমন অ্যান্টিহিস্টামিন ও মূত্রবর্ধক ওষুধ
-
অপুষ্টি এবং ভারসাম্যহীন খাদ্যাভ্যাস
-
মুখের ভিতরে আঘাত জনিত কারণ
গবেষণায় দেখা গেছে, লালা গ্রন্থির পাথর বছরে গড়ে ১ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পায় । তাই প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লক্ষণ ও উপসর্গ চেনার উপায়
লালা গ্রন্থির পাথরের প্রধান লক্ষণ হলো খাবার খাওয়ার সময় বা খাওয়ার আগে মুখে, গালে বা ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হওয়া । এটি ঘটে কারণ খাবারের সময় লালা উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পাথরের কারণে তা বের হতে পারে না।
অন্যান্য উপসর্গসমূহ:
-
গাল, মুখ বা ঘাড়ে ফোলাভাব ও কোমলতা
-
মুখ শুকিয়ে যাওয়া
-
গিলতে বা মুখ খুলতে অসুবিধা
-
আক্রান্ত স্থানে লালচে ভাব বা পুঁজ
-
কখনো কখনো জ্বর হতে পারে
চিকিৎসকেরা বলছেন, এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি ।
আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
বর্তমানে লালা গ্রন্থির পাথর নির্ণয়ের জন্য উচ্চমানের আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয়, যার নির্ভুলতা প্রায় ৯৫ শতাংশ । এছাড়াও সিটি স্ক্যান এবং সিয়ালোএন্ডোস্কোপি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
নির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতিসমূহ:
-
উচ্চমানের আল্ট্রাসাউন্ড: দ্রুত ও কার্যকর প্রাথমিক পরীক্ষা
-
সিয়ালোএন্ডোস্কোপি: নালীর ভিতরের অবস্থা সরাসরি দেখার পদ্ধতি
-
সিটি স্ক্যান: জটিল ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়
-
ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা: চিকিৎসকের সরাসরি পরীক্ষা
লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার আধুনিক উপায়
আজকের দিনে লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায় অনেক উন্নত এবং কার্যকর হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে যেখানে ৪০-৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরো গ্রন্থি অপসারণ করতে হতো, এখন সেটি কমে এসেছে মাত্র ৫ শতাংশেরও কম ।
রক্ষণশীল চিকিৎসা পদ্ধতি:
প্রাথমিক অবস্থায় নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:
-
পর্যাপ্ত পানি পান: দৈনিক ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন
-
গ্রন্থি ম্যাসাজ: নিয়মিত গ্রন্থিতে হালকা ম্যাসাজ করুন
-
টক খাবার সেবন: লেবুর রস বা টক ফলের রস খান
-
ব্যথানাশক ওষুধ: প্রয়োজনে নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ সেবন
সিয়ালোএন্ডোস্কোপি
সিয়ালোএন্ডোস্কোপি হলো লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার সবচেয়ে আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে লালা গ্রন্থির নালীর ভিতরে প্রবেশ করে সরাসরি পাথর দেখা ও অপসারণ করা হয় ।
সিয়ালোএন্ডোস্কোপির সুবিধাসমূহ:
-
গ্রন্থি সংরক্ষণ: পুরো গ্রন্থি অপসারণের প্রয়োজন নেই
-
উচ্চ সফলতার হার: প্রায় ৮০ শতাংশ সফলতার হার
-
ন্যূনতম কাটাকুটি: কোনো বড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই
-
দ্রুত সুস্থতা: রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন
চিকিৎসা প্রক্রিয়া:
ছোট পাথরের ক্ষেত্রে (২-৩ মিলিমিটার) সরাসরি ফোর্সেপ্স বা বাস্কেট দিয়ে অপসারণ করা হয় । বড় পাথরের ক্ষেত্রে প্রথমে ভেঙে টুকরো করে তারপর অপসারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৩০ মিনিট থেকে ৫ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে ।
ইন্ট্রাডাক্টাল লিথোট্রিপসি: অত্যাধুনিক পাথর ভাঙার পদ্ধতি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্ট্রাডাক্টাল শক ওয়েভ লিথোট্রিপসি (ISWL) একটি বৈপ্লবিক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশেরও বেশি সফলতার হার পাওয়া গেছে ।
লিথোট্রিপসির প্রকারভেদ:
-
নিউম্যাটিক লিথোট্রিপসি (IPL): বায়ু চাপ ব্যবহার করে পাথর ভাঙা
-
লেজার লিথোট্রিপসি: হো:YAG লেজার ব্যবহার করে পাথর ভাঙা
-
একস্ট্রাকর্পোরিয়াল লিথোট্রিপসি (ESWL): শরীরের বাইরে থেকে শক ওয়েভ প্রয়োগ
সার্জিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি
যেসব ক্ষেত্রে সিয়ালোএন্ডোস্কোপি বা লিথোট্রিপসি কার্যকর নয়, সেসব ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সার্জিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:
ট্রান্সওরাল ডাক্ট সার্জারি (TDS):
মুখের ভিতর থেকে ছোট কাটার মাধ্যমে পাথর অপসারণ করা হয় । এই পদ্ধতি বিশেষত সাবম্যান্ডিবুলার গ্রন্থির পাথরের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
কম্বাইন্ড অ্যাপ্রোচ:
সিয়ালোএন্ডোস্কোপি এবং ট্রান্সকিউটেনিয়াস (চামড়ার মধ্য দিয়ে) পদ্ধতির সমন্বয় । এই পদ্ধতিতে জটিল ক্ষেত্রেও সফল চিকিৎসা সম্ভব।
চিকিৎসার সাফল্যের হার ও পূর্বাভাস
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কল্যাণে লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায় এখন অনেক কার্যকর। গবেষণা অনুযায়ী:
-
সম্পূর্ণ নিরাময়: ৮০.৫ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন
-
আংশিক নিরাময়: ১৬.৭ শতাংশ রোগীর উপসর্গ দূর হয়
-
গ্রন্থি অপসারণ: মাত্র ২.৯ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রন্থি অপসারণ প্রয়োজন হয়
চিকিৎসার পূর্বাভাস নির্ধারক বিষয়সমূহ:
-
পাথরের আকার ও অবস্থান
-
পাথরের সংখ্যা
-
গ্রন্থির নালীর গঠন
-
রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য অবস্থা
প্রতিরোধ ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন
লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায় জানার পাশাপাশি প্রতিরোধ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ:
প্রতিরোধের উপায়সমূহ:
-
পর্যাপ্ত পানি পান: দৈনিক অন্তত ২-৩ লিটার পানি পান করুন
-
ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান লালা উৎপাদন কমিয়ে দেয়
-
সুষম খাদ্যাভ্যাস: শাকসবজি সমৃদ্ধ খাবার খান
-
মুখের স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখুন
-
নিয়মিত চেকআপ: বছরে অন্তত একবার দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
-
খাবার খাওয়ার সময় তীব্র ব্যথা
-
গাল বা চিবুকের নিচে ক্রমাগত ফোলাভাব
-
জ্বরের সাথে ব্যথা
-
মুখ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব
-
গিলতে বা কথা বলতে অসুবিধা
প্রারম্ভিক চিকিৎসা নেওয়া হলে চিকিৎসার ফলাফল অনেক ভালো হয় । দেরি করলে জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং চিকিৎসা কঠিন হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা খরচ ও সুবিধা
আধুনিক লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায়গুলো খরচ সাশ্রয়ী এবং কার্যকর। সিয়ালোএন্ডোস্কোপি একটি দিনের চিকিৎসা হিসেবে করা যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় অবশ করেই চিকিৎসা সম্ভব, যা রোগীর জন্য আরামদায়ক ।
বর্তমানে বেশ কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালে এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হয়েছে। তাই রোগীদের আর বিদেশে যেতে হয় না।
লালা গ্রন্থির পাথর দূর করার উপায় আজকের দিনে অত্যন্ত উন্নত ও কার্যকর হয়েছে। সিয়ালোএন্ডোস্কোপি এবং আধুনিক লিথোট্রিপসি পদ্ধতির মাধ্যমে প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন । প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলে গ্রন্থি অপসারণের প্রয়োজন হয় না। তাই এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সুবিধা গ্রহণ করুন।