Home remedies for joint pain: আপনি কি প্রতিদিন সকালে উঠে প্রথমেই অনুভব করেন হাঁটু বা কব্জির ব্যথা? গাঁটের ব্যথায় কি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে? চিন্তা করবেন না, আপনি একা নন। হাঁটুর ব্যথা বা গাঁটের সমস্যা এখন আর বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই, যে কোনও বয়সেই হানা দিতে পারে এই সমস্যা। আজকের এই ব্লগে, আমরা আপনাকে জানাবো গাঁটের ব্যথা উপশম করার ৫টি কার্যকরী ঘরোয়া উপায় যা বিজ্ঞানসম্মত এবং আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত। ডাক্তারি চিকিৎসার পাশাপাশি এই পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করে আপনি দ্রুত উপশম পেতে পারেন গাঁটের ব্যথার যন্ত্রণা থেকে।
গাঁটের ব্যথা কি এবং কেন হয়?
শরীরে দু’টি হাড় বা অস্থিসন্ধিকে সাধারণ বাংলায় গাঁট বলা হয়। এই অংশে ব্যথা হলে সে যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে ওঠে ক্রমশ। একসময় ধারণা করা হত গাঁটের ব্যথা শুধুমাত্র বয়স্কদের হয়, কিন্তু এখন আর তা সত্য নয়। শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালশিয়ামের অভাব, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত শরীরচর্চার অভাব – এই সবই গাঁটের ব্যথার অন্যতম কারণ। এছাড়া আর্থ্রাইটিস বা পুরনো আঘাত থেকেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গাঁটের ব্যথা হয়।
সাধারণত হাঁটু, কব্জি, কনুই এবং অন্যান্য গাঁটে এই ব্যথা দেখা যায়। রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লেই গাঁটের ব্যথা অনিবার্য। গাঁটের ব্যথার কারণে হাঁটা-চলার স্বাভাবিক গতি কমে আসে। কর্মদক্ষতাও কমে যায়। এই ব্যথাকে অবহেলা না করে শুরু থেকেই সতর্ক হওয়া ভীষণ জরুরি।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৬.৯% গাঁটের ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তি গত এক বছরে অন্তত একটি ঔষধ গ্রহণ করেছেন। ডাক্তারি ওষুধের পাশাপাশি ঘরোয়া উপায়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আসুন জেনে নিই গাঁটের ব্যথা দূর করার ৫টি কার্যকরী ঘরোয়া উপায়।
গাঁটের ব্যথার ঘরোয়া চিকিৎসা (Home remedies for joint pain)
১. ঠান্ডা-গরম সেঁক (Hot and Cold Compress)
হাঁটু বা গাঁটের ব্যথা কমাতে দারুণ কার্যকরী হল ঠান্ডা-গরম জলের সেঁক। যে অংশে ব্যথা, সেখানে পালা করে প্রথমে গরম জলের ব্যাগ এবং পরে নরম কাপড়ে মোড়ানো বরফের সেঁক দিন। এই পদ্ধতি কেন কার্যকর? ব্লাড সার্কুলেশন বা রক্ত সঞ্চালন ঠিক করে অস্থিসন্ধির অসাড়ভাব কমায় ওয়ার্ম কম্প্রেস। অস্বস্তি কমিয়ে গতিসঞ্চালনা বজায় রাখে হাল্কা গরমজলের মালিশ।
কিভাবে করবেন:
-
প্রথমে গরম জলের ব্যাগ ১০ মিনিট ধরে ব্যথার জায়গায় রাখুন
-
এরপর ৫ মিনিটের জন্য বরফের প্যাক ব্যবহার করুন
-
এভাবে ২-৩ বার করুন
শুধু ব্যথা বাড়লে নয়, রোজই এক বার করে এই গরম-ঠান্ডা সেঁক দিতে পারেন। এতে ব্যথা অনেকটা কম থাকবে।
২. হলুদ ও আদা চা (Turmeric and Ginger Tea)
হলুদ ও আদায় রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট যা যেকোনও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদে আছে কারকিউমিন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিইনফ্লেম্যাটরি যৌগ। উষ্ণ দুধ বা জলে মিশিয়ে পান করলে গাঁটের ব্যথা ও ফোলাভাব কমে যায়। হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন ব্যথা সৃষ্টিকারী হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়।
আদাতেও আছে অ্যান্টি ইনফ্লেম্যাটরি গুণ। জিঞ্জার টি বা আদা চা পান করতে পারেন। খাবারে ও রান্নায় নানাভাবে আদা রাখলে গাঁটের যন্ত্রণা কম থাকবে।
হলুদ-আদা চা তৈরির পদ্ধতি:
-
দু’কাপ জলে হলুদ ও আদা ফুটিয়ে অর্ধেক করে নিন
-
এবার ওই মিশ্রণে এক চামচ মধু মিশিয়ে দিন
-
দিনে অন্তত দু’বার এই চা পান করুন
৩. অ্যাপেল সাইডার ভিনিগার (Apple Cider Vinegar)
অ্যাপেল সাইডার ভিনিগারে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস। হাঁটুর ব্যথা কমাতে দারুণ উপকারী এটি। এই উপাদানগুলি শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
ব্যবহারের উপায়:
-
এক কাপ উষ্ণ জলে দু’চামচ ভিনিগার ও কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে দিনে ৩-৪ বার খেতে পারেন
-
এছাড়া অ্যাপেল সিডার ভিনিগারে অলিভ অয়েল মিশিয়ে মালিশ করলেও উপকার পেতে পারেন
অ্যাপেল সাইডার ভিনিগার শরীরের অম্লীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা ব্যথার জন্য দায়ী প্রদাহজনিত অবস্থা কমাতে সহায়তা করে। তবে একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
৪. অলিভ অয়েল মালিশ (Olive Oil Massage)
অলিভ অয়েল অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টে ভরপুর। খাবারে দেশি ঘি ব্যবহার করুন। অলিভ অয়েলেও রান্না করতে পারেন, এতে উপকার পাবেন। অলিভ অয়েলের নিয়মিত মালিশ রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং গাঁটের অংশে পুষ্টি সরবরাহ করে। এছাড়া এতে প্রদাহ কমে এবং ব্যথা উপশম হয়।
মালিশের পদ্ধতি:
-
অলিভ অয়েলের সঙ্গে সৈন্ধব নুন মিশিয়ে ব্যথার জায়গায় মালিশ করতে পারেন
-
সৈন্ধব নুনে প্রচুর মাত্রায় ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, কপার ও জিঙ্ক থাকে
-
তিলতেল মেশান লবঙ্গ ও হলুদের সঙ্গে। ব্যথার জায়গায় মালিশ করলে আরাম পাবেন
অ্যান্টিইনফ্লেম্যাটরি গুণের জন্য বিখ্যাত ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ির তেল। হাল্কা গরম বা উষ্ণ ক্যাস্টর অয়েল মালিশ করুন ব্যথার জায়গায়। অনেকটা আরাম পাবেন। ব্যবহার করতে পারেন পুলটিশ হিসেবেও।
৫. নুন মিশ্রিত গরম জলে সেঁক (Warm Salt Water Soak)
নুন মিশ্রিত গরম জলে ব্যথিত অংশ ডুবিয়ে রাখলে দ্রুত উপশম পাওয়া যায়। নুনের ম্যাগনেশিয়াম উপাদান শরীরে শোষিত হয়ে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া গরম জল সেঁক রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
করার পদ্ধতি:
-
ঈষদুষ্ণ জলে নুন মিশিয়ে তার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটু ডুবিয়ে রাখুন
-
হট ওয়াটার ব্যাগও ব্যবহার করতে পারেন
-
ব্যথা কমাতে দিনে দুই থেকে তিন বার এই টোটকা মেনে চলুন
অন্যান্য সহায়ক পদ্ধতি (Other helpful methods)
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
গাঁটের ব্যথা কমাতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। অত্যধিক মাত্রায় টক জাতীয় খাবাব এড়িয়ে চলুন। খাবারে নুনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ভাজাভুজি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
সাদা তিল গাঁটের ব্যথা দূর করতে দারুণ উপকারী। রান্নায় তিল বেটে ব্যবহার করতে পারেন। স্বাদও বাড়বে আর ব্যথাও কমবে। এ ছাড়া স্যালাডেও তিল ব্যবহার করা যেতে পারে। রাতভর ভিজিয়ে রাখা মেথির জল সকালে খালি পেটে পান করলেও উপকার পাবেন।
স্ট্রেস, ইনফ্লেম্যাশন কমায় অশ্বগন্ধা। সার্বিক সুস্থতার সঙ্গে গাঁটের ব্যথা কমাতে ডায়েটে রাখুন অশ্বগন্ধার গুঁড়ো বা ক্যাপসুল।
নিয়মিত ব্যায়াম
গাঁটের ব্যথা কমাতে নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা জরুরি। গাঁটের ব্যথায় ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খান এবং ব্যায়াম করুন। তাই চি (Tai Chi) জাতীয় ধীরগতির ব্যায়াম করতে পারেন। এই ধরণের ব্যায়াম জয়েন্টের উপর চাপ না দিয়ে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
যোগব্যায়াম গাঁটের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এই মিশ্রণ শ্বাস প্রশ্বাস, ধ্যান এবং হালকা ব্যায়াম ৫,০০০ বছর আগে ভারতে উদ্ভাবিত হয়েছিল। এটি আপনার শরীর এবং মনের জন্য ভালো। এটি জয়েন্টের ব্যথা কমাতে, নমনীয়তা বাড়াতে এবং স্ট্রেস এবং উত্তেজনা দূর করতে সাহায্য করে।
পুষ্টিকর খাবার
গাঁটের সুস্থতা বজায় রাখতে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবার খান। দু’কাপ দুধের সঙ্গে এক চামচ বাদাম, আখরোটের গুঁড়ো ও সামান্য মাত্রায় হলুদের গুঁড়ো ভাল ভাবে মিশিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ ফুটিয়ে নিন। মিশ্রণের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেলে ঠান্ডা করে খেয়ে ফেলুন। নিয়মিত এই দুধ খাদ্যতালিকায় রাখলে ব্যথায় আরাম পাবেন।
আদা খেলে হাঁটুর ব্যথা অনেকটা কমে। এ ক্ষেত্রে আদা দেওয়া চা খেলেও উপকার পাবেন।
কবে ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
ব্যথা কমাতে ঘরোয়া উপায়ে ভরসা রাখার পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেও ভুলবেন না। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন:
-
যদি ব্যথা দীর্ঘদিন ধরে থাকে
-
গাঁটে লালভাব, ফোলাভাব বা উষ্ণতা দেখা দেয়
-
ব্যথার কারণে হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয়
-
ব্যথার সাথে জ্বর বা শরীর খারাপ লাগে
-
হঠাৎ করে ব্যথা অসহনীয় হয়ে ওঠে
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডাক্তারি নির্দেশে যারা চিকিৎসা নেন তারা বেশি উপকার পান। ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা জয়েন্ট ইনজেকশন (২০.৬%) ও প্রেসক্রিপশন পেইন মেডিসিন (২৬.৭%) ব্যবহার করেন, যা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তুলনায় অনেক বেশি (যথাক্রমে ৬.৪% ও ৮.৫%)।
গাঁটের ব্যথা অনেকেরই জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করে। তবে সঠিক পদ্ধতিতে ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে এই ব্যথা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ঠান্ডা-গরম সেঁক, হলুদ-আদা চা, অ্যাপেল সাইডার ভিনিগার, অলিভ অয়েল মালিশ, এবং নুন মিশ্রিত গরম জলে সেঁক – এই পাঁচটি পদ্ধতি নিয়মিত অনুসরণ করলে গাঁটের ব্যথায় অবশ্যই উপশম পাবেন।মনে রাখবেন, গাঁটের ব্যথাকে অবহেলা না করে শুরু থেকেই সতর্ক হওয়া ভীষণ জরুরি। ঘরোয়া উপায় ব্যথা কমাতে সাহায্য করলেও ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া জরুরি। একসাথে ব্যায়াম, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করলে গাঁটের ব্যথা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সুস্থ থাকুন, ব্যথামুক্ত জীবন উপভোগ করুন।