Scabies Medicine Name: স্ক্যাবিস (Scabies) বা খোঁসপাঁচড়া, একটি অত্যন্ত সংক্রামক ত্বকের রোগ, যা সারাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি ‘সারকোপটেস স্ক্যাবি’ (Sarcoptes scabiei) নামক একটি আণুবীক্ষণিক মাইট (Mite) বা কীটের কারণে হয়। এই রোগটি হলে ত্বকে তীব্র চুলকানি হয়, যা বিশেষ করে রাতের বেলা অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবে সুখবর হলো, সঠিক চিকিৎসায় এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য। স্ক্যাবিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত প্রধান ঔষধগুলিকে “স্ক্যাবিসাইড” (Scabicide) বলা হয়, কারণ এগুলি স্ক্যাবিস মাইটকে মেরে ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) এর মতে, স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী এবং বহুল ব্যবহৃত ঔষধ হলো পারমেথ্রিন ৫% (Permethrin 5%) ক্রিম। এটি টপিকাল বা ত্বকের ওপর প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গুরুতর সংক্রমণে বা যখন ক্রিম কাজ করে না, তখন ডাক্তাররা খাওয়ার ঔষধ হিসেবে আইভারমেকটিন (Ivermectin) ট্যাবলেট সুপারিশ করেন।
এই প্রবন্ধে আমরা স্ক্যাবিস কেন হয়, এর লক্ষণগুলি কী কী, এবং কোন কোন ঔষধ (ট্যাবলেট ও ক্রিম) এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আমরা ঔষধ ব্যবহারের সঠিক নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলিও তুলে ধরব।
স্ক্যাবিস আসলে কী? এটি কেন এত চুলকায়?
স্ক্যাবিস কোনো সাধারণ অ্যালার্জি বা ত্বকের ইনফেকশন নয়। এটি একটি পরজীবীঘটিত রোগ।
Tetrasol ঔষধ ব্যবহারের নিয়ম: কেন ব্যবহার করা হয়?
রোগের কারণ: আণুবীক্ষণিক শত্রু
স্ক্যাবিস রোগের জন্য দায়ী হলো আট পা-বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র মাইট, যার নাম Sarcoptes scabiei var. hominis। এই মাইটটি এতই ছোট যে খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না। স্ত্রী মাইটগুলি মানুষের ত্বকের উপরের স্তরে (Epidermis) ঢুকে সুড়ঙ্গ (Burrow) তৈরি করে এবং সেখানে প্রতিদিন ২-৩টি করে ডিম পাড়ে।
এই মাইট, তাদের ডিম এবং তাদের মল (Feces) ত্বকের ভেতরে এক ধরনের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া (Allergic Reaction) তৈরি করে। এই অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার কারণেই ত্বকে তীব্র চুলকানি এবং লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথমবার আক্রান্ত হলে লক্ষণ দেখা দিতে ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে, কারণ ইমিউন সিস্টেমের প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে সময় লাগে। তবে, যিনি আগেও স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়েছেন, তার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলি মাত্র ১ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই পুনরায় দেখা দিতে পারে।
কীভাবে এটি ছড়ায়?
স্ক্যাবিস অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এটি প্রাথমিকভাবে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ এবং দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি ত্বক থেকে ত্বকের (Skin-to-skin) যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত, করমর্দন বা সংক্ষিপ্ত আলিঙ্গনের মাধ্যমে এটি ছড়ায় না।
- সরাসরি যোগাযোগ: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা এক বিছানায় ঘুমায়, তাদের মধ্যে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- পরোক্ষ যোগাযোগ: যদিও এটি কম সাধারণ, তবুও আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পোশাক, বিছানার চাদর, বা তোয়ালে ব্যবহারের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। তবে, মাইটগুলি মানবদেহ ছাড়া ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার বেশি বাঁচতে পারে না।
স্ক্যাবিস যেকোনো বয়সের, লিঙ্গের বা আর্থ-সামাজিক স্তরের মানুষের হতে পারে। এটি দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি বা অপরিচ্ছন্নতার লক্ষণ নয়, যদিও জনাকীর্ণ পরিবেশে (যেমন নার্সিং হোম, কারাগার, বা চাইল্ড কেয়ার সেন্টার) এটি দ্রুত মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।
স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণগুলি চিনে নিন
স্ক্যাবিসের লক্ষণগুলি প্রায়শই অন্যান্য ত্বকের রোগের মতো মনে হতে পারে, তাই সঠিক সময়ে তা চেনা খুব জরুরি।
তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতে)
এটিই স্ক্যাবিসের প্রধান এবং সবচেয়ে কষ্টদায়ক লক্ষণ। চুলকানি সাধারণত রাতে বা গরম জলে স্নান করার পর তীব্র আকার ধারণ করে। এর কারণ হলো, মাইটগুলি এই সময়ে বেশি সক্রিয় থাকে।
ত্বকের ওপর ফুসকুড়ি ও গর্ত (Burrows)
ত্বকের ওপর ছোট ছোট লাল ফুসকুড়ি (Papular rash) বা ব্রণসদৃশ গোটা দেখা দেয়। অনেক সময়, ত্বকের ওপর মাইটগুলির তৈরি করা সুড়ঙ্গগুলি সরু, আঁকাবাঁকা, ধূসর-সাদা বা ত্বকের রঙের রেখার মতো দেখা যায়।
এই লক্ষণগুলি সাধারণত শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বেশি দেখা যায়, যেমন:
- আঙুলের ফাঁকে (Webbing between fingers)
- কব্জি, কনুই, এবং বগলের ভাঁজে
- কোমর বা বেল্টের লাইনে
- স্তনবৃন্তের চারপাশে (মহিলাদের ক্ষেত্রে)
- নিতম্ব এবং যৌনাঙ্গের চারপাশে (পুরুষদের ক্ষেত্রে)
- শিশুদের ক্ষেত্রে: মুখ, মাথা, ঘাড়, হাতের তালু এবং পায়ের তলায়ও এটি দেখা যেতে পারে।
ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস (Crusted Scabies)
এটি স্ক্যাবিসের একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং বিরল রূপ, যা আগে “নরওয়েজিয়ান স্ক্যাবিস” (Norwegian Scabies) নামে পরিচিত ছিল। এটি সাধারণত সেই সব ব্যক্তিদের হয় যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল (যেমন HIV/AIDS আক্রান্ত, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন এমন রোগী, বা বয়স্ক ব্যক্তি)।
ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসে, ত্বকে হাজার হাজার বা এমনকি লক্ষ লক্ষ মাইট থাকতে পারে (সাধারণ স্ক্যাবিসে মাত্র ১০-১৫টি থাকে)। এর ফলে ত্বকে পুরু, খসখসে, ধূসর রঙের আবরণ (Crusts) তৈরি হয় এবং চুলকানি কম থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং এর জন্য দ্রুত ও নিবিড় চিকিৎসা প্রয়োজন।
ত্বকে সারা ক্ষণ চুলকানি: কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধের উপায়
স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম (ট্যাবলেট ও ক্রিম)
স্ক্যাবিসের চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহৃত ঔষধগুলিকে ‘স্ক্যাবিসাইড’ বলা হয়। এই ঔষধগুলি শুধুমাত্র ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। এখানে সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং কার্যকরী ঔষধগুলির একটি সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া হলো।
টপিকাল ঔষধ (ক্রিম ও লোশন)
এগুলি হলো সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি, যা সরাসরি ত্বকে প্রয়োগ করা হয়।
১. পারমেথ্রিন ৫% (Permethrin 5% Cream)
- কার্যকারিতা: পারমেথ্রিনকে স্ক্যাবিস চিকিৎসার জন্য “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” বা সবচেয়ে কার্যকরী ঔষধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দ্বারা প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে সুপারিশকৃত।
- কীভাবে কাজ করে: এটি একটি সিন্থেটিক পাইরেথ্রয়েড, যা মাইট এবং তাদের ডিমের স্নায়ুতন্ত্রকে অবশ করে দেয় এবং তাদের মেরে ফেলে।
- ব্যবহারবিধি: সাধারণত, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সারা শরীরে ক্রিমটি ভালোভাবে মাখতে হয়। নখের নিচে, আঙুলের ফাঁকে, এবং ত্বকের সমস্ত ভাঁজে যেন ক্রিম পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি ৮ থেকে ১৪ ঘণ্টা শরীরে রাখার পর স্নান করে ধুয়ে ফেলতে হয়।
- নিরাপত্তা: এটি ২ মাসের বেশি বয়সী শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ত্বকে সাময়িক জ্বালাপোড়া, চুলকানি বা লালভাব দেখা দিতে পারে।
২. ক্রোটামিটন ১০% (Crotamiton 10% Cream/Lotion)
- কার্যকারিতা: এটি পারমেথ্রিনের চেয়ে কম কার্যকরী হতে পারে, তবে এর একটি বিশেষ সুবিধা হলো এটি চুলকানি কমাতেও সাহায্য করে (Antipruritic property)।
- ব্যবহারবিধি: এটি সাধারণত ২৪ ঘণ্টা পর পর দুইবার প্রয়োগ করতে হয়, অথবা টানা ২-৫ দিন প্রতিদিন একবার করে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে (ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী)।
- নিরাপত্তা: শিশুদের ক্ষেত্রে এর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়।
৩. বেনজাইল বেনজোয়েট ২৫% (Benzyl Benzoate 25% Lotion)
- কার্যকারিতা: এটি একটি পুরোনো এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা, যা এখনও অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হয়। এটি বেশ কার্যকরী, তবে পারমেথ্রিনের তুলনায় ত্বকে বেশি জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে।
- ব্যবহারবিধি: এটি সাধারণত ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রয়োগ করা হয়, এবং কখনও কখনও পরপর ২-৩ দিন ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে।
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: এটি ত্বকে তীব্র জ্বালাপোড়া বা শুষ্কভাব সৃষ্টি করতে পারে, তাই সংবেদনশীল ত্বকে বা শিশুদের ক্ষেত্রে এটি সাবধানে ব্যবহার করা হয়।
৪. সালফার মলম ৫%-১০% (Sulfur Ointment 5%-10%)
- কার্যকারিতা: সালফার একটি প্রাচীন চিকিৎসা। এটি পারমেথ্রিনের মতো দ্রুত কার্যকরী না হলেও, এটি একটি অত্যন্ত নিরাপদ বিকল্প।
- ব্যবহারবিধি: এটি সাধারণত টানা ৫ থেকে ৭ দিন, প্রতিদিন রাতে সারা শরীরে প্রয়োগ করতে হয় এবং সকালে ধুয়ে ফেলতে হয়।
- নিরাপত্তা: এটি গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদায়ী মা এবং ২ মাসের কম বয়সী নবজাতকদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান অসুবিধা হলো এটিতে গন্ধ থাকতে পারে এবং পোশাকে দাগ লাগতে পারে।
৫. লিনডেন ১% (Lindane 1% Lotion)
- গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: লিনডেন একটি অর্গানোক্লোরিন যৌগ। এটি কার্যকরী হলেও, এর সম্ভাব্য নিউরোটক্সিসিটি বা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের (যেমন খিঁচুনি) ঝুঁকির কারণে এটি আর প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত করেছে। এটি শুধুমাত্র তখনই ব্যবহৃত হয় যখন অন্য কোনো চিকিৎসা কাজ করে না।
ওরাল বা খাওয়ার ঔষধ (ট্যাবলেট)
যখন টপিকাল ক্রিম কাজ করে না, সংক্রমণ খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ে, অথবা রোগীর পক্ষে সারা শরীরে ক্রিম লাগানো সম্ভব হয় না (যেমন ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসের ক্ষেত্রে), তখন ডাক্তার খাওয়ার ঔষধ সুপারিশ করতে পারেন।
আইভারমেকটিন (Ivermectin)
- কার্যকারিতা: আইভারমেকটিন স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকরী একটি ওরাল (খাওয়ার) ঔষধ। এটি পরজীবীর স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হেনে তাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে এবং মেরে ফেলে।
- ব্যবহারবিধি: এটি সাধারণত রোগীর ওজন অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ৭ থেকে ১৪ দিনের ব্যবধানে মোট দুটি ডোজ দেওয়া হয়। প্রথম ডোজটি প্রাপ্তবয়স্ক মাইটগুলিকে মেরে ফেলে, এবং দ্বিতীয় ডোজটি প্রথম ডোজের পর ডিম ফুটে বের হওয়া নতুন মাইটগুলিকে ধ্বংস করে।
- কখন ব্যবহৃত হয়: এটি ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসের চিকিৎসার জন্য প্রথম পছন্দ। এছাড়া, বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব (Outbreak) নিয়ন্ত্রণে বা যারা ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন না, তাদের ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহৃত হয়।
- নিরাপত্তা: এটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ। তবে, গর্ভবতী বা স্তন্যদায়ী মহিলাদের এবং ১৫ কেজির কম ওজনের শিশুদের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত সুপারিশ করা হয় না।
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বা বমিভাব হতে পারে, তবে তা সাধারণত হালকা হয়।
সারা গায়ে চুলকানির ওষুধ: এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায়!
স্ক্যাবিস ঔষধের তুলনা (সংক্ষিপ্ত সারণী)
নীচের সারণীতে প্রধান ঔষধগুলির একটি সংক্ষিপ্ত তুলনা দেওয়া হলো:
| ঔষধের নাম (Name) | ধরণ (Type) | কার্যকারিতা (Efficacy) | কাদের জন্য সাধারণত নিরাপদ |
| পারমেথ্রিন ৫% | ক্রিম (Topical) | খুব উচ্চ (Gold Standard) | প্রাপ্তবয়স্ক, গর্ভবতী মহিলা, ২+ মাসের শিশু |
| আইভারমেকটিন | ট্যাবলেট (Oral) | খুব উচ্চ (বিশেষত ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসে) | প্রাপ্তবয়স্ক, ১৫+ কেজি ওজনের শিশু |
| বেনজাইল বেনজোয়েট ২৫% | লোশন (Topical) | উচ্চ | প্রাপ্তবয়স্ক (শিশুদের জন্য কম ব্যবহৃত) |
| সালফার মলম ৫%-১০% | মলম (Topical) | মাঝারি থেকে উচ্চ | নবজাতক (<২ মাস), গর্ভবতী মহিলা |
| ক্রোটামিটন ১০% | ক্রিম (Topical) | মাঝারি (চুলকানিও কমায়) | প্রাপ্তবয়স্ক |
| লিনডেন ১% | লোশন (Topical) | উচ্চ | শুধুমাত্র শেষ বিকল্প হিসেবে (ঝুঁকিপূর্ণ) |
ঔষধ ব্যবহারের সঠিক নিয়ম ও সতর্কতা
ঔষধের নাম জানার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হলো তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা। ভুল ব্যবহারে চিকিৎসা ব্যর্থ হতে পারে।
ক্রিম বা লোশন ব্যবহারের সঠিক ধাপ
- স্নান করা: ঔষধ প্রয়োগের আগে হালকা গরম জলে স্নান করে ত্বক পরিষ্কার ও শুকিয়ে নিন। ত্বক সম্পূর্ণ শুষ্ক এবং শীতল হতে দিন (গরম ত্বকে ঔষধ লাগালে শোষণ বেড়ে গিয়ে জ্বালা করতে পারে)।
- সঠিক প্রয়োগ: গলা থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত সারা শরীরে ক্রিম বা লোশনটি ভালোভাবে মাখুন। কোনো জায়গা যেন বাদ না যায়।
- বিশেষ স্থান: আঙুলের ফাঁক, নখের নিচে, কব্জি, কনুই, বগল, যৌনাঙ্গ, এবং নিতম্বের ভাঁজে বিশেষ মনোযোগ দিন। নখ ছোট করে কেটে নেওয়া ভালো।
- শিশুদের ক্ষেত্রে: শিশুদের ক্ষেত্রে মুখ, কপাল এবং মাথার তালুতেও (চোখ ও মুখ বাদ দিয়ে) সাবধানে প্রয়োগ করতে হতে পারে। অবশ্যই ডাক্তারের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
- নির্দিষ্ট সময় রাখা: পারমেথ্রিনের ক্ষেত্রে ৮-১৪ ঘণ্টা (সাধারণত রাতে ঘুমানোর আগে লাগিয়ে সকালে ধুয়ে ফেলা হয়) বা ডাক্তারের নির্দেশিত সময় পর্যন্ত ঔষধটি ত্বকে রাখুন।
- হাত ধোয়া: ঔষধ লাগানোর পর যদি হাত ধুয়ে ফেলেন (যেমন টয়লেট ব্যবহারের পর), তবে হাতে অবশ্যই পুনরায় ঔষধ লাগাতে হবে।
- ধুয়ে ফেলা: নির্দিষ্ট সময় পর, স্নান করে সমস্ত ঔষধ ভালো করে ধুয়ে ফেলুন এবং পরিষ্কার পোশাক পরুন।
চিকিৎসার পরেও চুলকানি কেন থাকে?
এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্ন। অনেকেই ভাবেন ঔষধ কাজ করেনি।
বাস্তবতা হলো, স্ক্যাবিসের সফল চিকিৎসার পরেও চুলকানি আরও ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এর কারণ হলো, ঔষধ মাইট এবং ডিম মেরে ফেললেও, ত্বকের নিচে মরে যাওয়া মাইট এবং তাদের মল থেকে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। একে বলা হয় “পোস্ট-স্ক্যাবিটিক প্রুরিটাস” (Post-scabetic pruritus)।
এই সময়ে চুলকানি কমানোর জন্য ডাক্তাররা কিছু সহায়ক চিকিৎসার পরামর্শ দেন:
- অ্যান্টিহিস্টামিন: চুলকানি কমানোর জন্য খাওয়ার অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট (যেমন সেটিরিজিন বা লোরাটাডিন) দেওয়া হতে পারে।
- স্টেরয়েড ক্রিম: চুলকানি এবং প্রদাহ কমাতে হালকা কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিম (যেমন হাইড্রোকার্টিসোন) ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
- ময়েশ্চারাইজার: ত্বককে আর্দ্র রাখতে ক্যালামাইন লোশন বা ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উপকারী।
- ঠান্ডা সেঁক: চুলকানির জায়গায় ঠান্ডা সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যায়।
সতর্কতা: যদি ৪ সপ্তাহ পরেও চুলকানি না কমে, অথবা নতুন করে ফুসকুড়ি বা সুড়ঙ্গ দেখা দেয়, তবে বুঝতে হবে চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছে বা পুনরায় সংক্রমণ ঘটেছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আবার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
স্ক্যাবিস প্রতিরোধ ও পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা
শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করলেই স্ক্যাবিস নির্মূল হয় না। একই সাথে পরিবেশ পরিষ্কার করা এবং সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা অপরিহার্য।
১. পরিবারের সকলের একযোগে চিকিৎসা
স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে বসবাসকারী পরিবারের সকল সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের (Sexual partners) একই সময়ে চিকিৎসা করা—এমনকি যদি তাদের কোনো লক্ষণ নাও থাকে। কারণ, লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, এবং এই সময়ের মধ্যে তারা অজান্তেই রোগটি ছড়িয়ে দিতে পারে। এই পদক্ষেপটি আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি (AAD) দ্বারা জোরালোভাবে সুপারিশ করা হয়।
২. পোশাক ও বিছানাপত্র পরিষ্কার করা
চিকিৎসা শুরু করার দিন বা তার আগের তিন দিনে (৭২ ঘণ্টা) ব্যবহৃত সমস্ত পোশাক, বিছানার চাদর, বালিশের কভার এবং তোয়ালে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- গরম জলে ধোয়া: এই জিনিসগুলি খুব গরম জলে (কমপক্ষে ৫০° সেলসিয়াস বা ১২২° ফারেনহাইট) ধুয়ে ফেলুন।
- গরম ড্রায়ার: ধোয়ার পর সেগুলিকে হাই-হিট সেটিংয়ে ড্রায়ারে শুকিয়ে নিন।
- ব্যাগিং (Bagging): যে জিনিসগুলি ধোয়া সম্ভব নয় (যেমন কিছু খেলনা, জুতো, কোট), সেগুলিকে একটি এয়ার-টাইট প্লাস্টিক ব্যাগে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা (৩ দিন) বা নিরাপদে থাকার জন্য এক সপ্তাহ পর্যন্ত সিল করে রেখে দিন। মাইটগুলি মানবদেহ ছাড়া কয়েক দিনের বেশি বাঁচতে পারে না।
৩. ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা
চিকিৎসা শুরু করার দিনটিতে বাড়ি এবং আসবাবপত্র ভালোভাবে ভ্যাকুয়াম (Vacuum) করুন। বিশেষ করে কার্পেট এবং সোফা। ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসের ক্ষেত্রে, আরও নিবিড়ভাবে পরিবেশ পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
স্ক্যাবিস সম্পর্কিত পরিসংখ্যান ও তথ্য
স্ক্যাবিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
- বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্যমতে, যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে সারা বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত থাকে।
- সংক্রমণের ঝুঁকি: এটি শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। জনবহুল এলাকা এবং ট্রপিক্যাল বা উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলিতে এর প্রাদুর্ভাব বেশি।
- সেকেন্ডারি ইনফেকশন: স্ক্যাবিসের কারণে চুলকানোর ফলে ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এই ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যাকটেরিয়া (যেমন Staphylococcus aureus বা Streptococcus pyogenes) প্রবেশ করে সেকেন্ডারি ইনফেকশন (যেমন ইম্পেটিগো বা সেলুলাইটিস) হতে পারে। কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে, এই ইনফেকশন থেকে সেপসিস (রক্তের ইনফেকশন) বা কিডনি রোগও (Post-streptococcal glomerulonephritis) হতে পারে।
স্ক্যাবিস নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা
- ভুল ধারণা ১: স্ক্যাবিস শুধু অপরিচ্ছন্নতার কারণে হয়।
- সত্য: এটি সম্পূর্ণ ভুল। স্ক্যাবিস যেকোনো পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিরও হতে পারে। এটি ঘনিষ্ঠ ত্বকের যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ায়।
- ভুল ধারণা ২: পোষা প্রাণী থেকে স্ক্যাবিস ছড়ায়।
- সত্য: মানুষের স্ক্যাবিস মাইট (Human scabies mite) প্রাণীদেহে বাঁচতে পারে না। প্রাণীদের যে ‘ম্যাঞ্জ’ (Mange) রোগ হয়, তা ভিন্ন ধরনের মাইট দ্বারা সৃষ্ট এবং তা মানুষের ত্বকে সাময়িক চুলকানি সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ করতে পারে না।
- ভুল ধারণা ৩: স্ক্যাবিস নিজে থেকেই সেরে যায়।
- সত্য: স্ক্যাবিস কখনোই নিজে থেকে সারে না। এটি নির্মূল করার জন্য অবশ্যই স্ক্যাবিসাইড ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
কখন অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন?
স্ক্যাবিসের লক্ষণ দেখা দিলে তা ঘরোয়া টোটকায় সারানোর চেষ্টা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন:
- যদি আপনার বা আপনার পরিবারের কারো স্ক্যাবিসের লক্ষণ (তীব্র রাতের চুলকানি, ফুসকুড়ি) দেখা দেয়।
- যদি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় (যেমন আপনি কেমোথেরাপি নিচ্ছেন বা HIV পজিটিভ) এবং স্ক্যাবিসের লক্ষণ দেখা দেয়।
- যদি চিকিৎসার (যেমন পারমেথ্রিন ক্রিম) এক কোর্স শেষ করার ৪ সপ্তাহ পরেও চুলকানি না কমে বা নতুন করে ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
- যদি ত্বকের কোনো স্থানে পুঁজ, ফোলাভাব, বা জ্বর আসে (যা সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের লক্ষণ)।
স্ক্যাবিস একটি কষ্টদায়ক রোগ হলেও, এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। সঠিক ঔষধের ব্যবহার, পরিবারের সকলের একযোগে চিকিৎসা, এবং পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।











