আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, শেখার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের চাবিকাঠি। ছাত্রছাত্রী, পেশাদার বা সাধারণ মানুষ, সকলেরই নতুন কিছু শেখার এবং মনে রাখার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেকেই স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা বা পড়া মনে রাখতে না পারার সমস্যায় ভোগেন। এই প্রতিবেদনে আমরা স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৯টি বৈজ্ঞানিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনাকে আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
১. শেখার জন্য সঠিক সময় নির্বাচন করুন (The right time to learn)
আমাদের মস্তিষ্ক দিনের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কাজ ভালোভাবে করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নতুন কিছু শেখার জন্য দুপুরবেলা সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ এই সময়ে আমাদের মস্তিষ্ক নতুন তথ্য গ্রহণ করার জন্য সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে, সকালবেলা আমাদের মস্তিষ্ক সৃজনশীল কাজের জন্য বেশি উপযোগী। তাই, আপনার পড়াশোনার রুটিন এমনভাবে তৈরি করুন যাতে নতুন এবং কঠিন বিষয়গুলো দুপুরের দিকে এবং রিভিশন বা সহজ বিষয়গুলো সকালের দিকে রাখতে পারেন।
২. তথ্যের ছোট ছোট অংশ তৈরি করুন (Chunking)
একবারে অনেক বেশি তথ্য মনে রাখা কঠিন হতে পারে। তাই, বড় কোনো বিষয়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন। এই পদ্ধতিকে চাংকিং (Chunking) বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি দীর্ঘ ফোন নম্বরকে ৩-৪টি অংশে ভাগ করে মনে রাখা অনেক সহজ। এই কৌশলটি পড়াশোনার ক্ষেত্রেও সমানভাবে কার্যকর। একটি বড় অধ্যায়কে কয়েকটি ছোট ছোট অনুচ্ছেদে ভাগ করে পড়ুন এবং প্রতিটি অনুচ্ছেদ পড়ার পর তা মনে করার চেষ্টা করুন।
৩. নোট তৈরি করুন (Take Notes)
ক্লাসে বা কোনো আলোচনায় সক্রিয়ভাবে নোট নেওয়া শেখার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাতে-কলমে নোট নিলে আমাদের মস্তিষ্ক তথ্যের প্রক্রিয়াকরণে আরও বেশি সক্রিয় থাকে, যা টাইপ করার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হাতে নোট নেন, তারা কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা এবং বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে টাইপ করা শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো ফল করেন। তাই, পরেরবার যখন কিছু শিখবেন, তখন হাতে নোট নেওয়ার অভ্যাস করুন।
৪. নিজেকে পরীক্ষা করুন (Test Yourself)
যা কিছু পড়েছেন, তা মনে আছে কিনা তা জানার জন্য নিজেকে নিয়মিত পরীক্ষা করা একটি অত্যন্ত কার্যকরী কৌশল। এর জন্য আপনি কুইজ, মক টেস্ট বা পুরোনো প্রশ্নপত্র সমাধান করতে পারেন। যখন আমরা নিজেদের পরীক্ষা করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলো মনে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে, যা স্মৃতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
৫. পর্যাপ্ত ঘুমান (Get Enough Sleep)
ঘুম আমাদের মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সারাদিনের সংগৃহীত তথ্যগুলোকে সংগঠিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি দুটোই কমে যায়। তাই, ভালো ফলাফলের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুমের দিকেও নজর দিন।
৬. বিভিন্ন বিষয় একসাথে পড়ুন (Interleaving)
একই বিষয় দীর্ঘক্ষণ ধরে না পড়ে, বিভিন্ন বিষয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ুন। এই পদ্ধতিকে ইন্টারলিভিং (Interleaving) বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ৩০ মিনিট গণিত পড়ার পর, ৩০ মিনিট বিজ্ঞান পড়ুন এবং তারপর আবার গণিতে ফিরে আসুন। এই কৌশলটি আমাদের মস্তিষ্ককে বিভিন্ন ধরণের সমস্যার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে, যা শেখার প্রক্রিয়াকে আরও গভীর এবং স্থায়ী করে তোলে।
৭. মনঃসংযোগের জন্য ব্যায়াম করুন (Practice Mindfulness)
নিয়মিত ধ্যান বা মাইন্ডফুলনেস ব্যায়াম আমাদের মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিট ধ্যান করলে আমাদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মনোযোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী।
৮. শারীরিক ব্যায়াম করুন (Exercise Regularly)
শারীরিক ব্যায়াম শুধু আমাদের শরীরকেই সুস্থ রাখে না, আমাদের মস্তিষ্ককেও সুস্থ রাখে। ব্যায়ামের সময় আমাদের মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নিউরোন তৈরি হতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো বা যেকোনো ধরণের শারীরিক ব্যায়াম আপনার স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে।
৯. পুষ্টিকর খাবার খান (Eat a Healthy Diet)
আমাদের মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে কাজ করার জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন – মাছ, বাদাম, ফল এবং সবুজ শাকসবজি আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করুন, কারণ এগুলো আমাদের স্মৃতিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই কৌশলগুলো অনুসরণ করলে আপনি আপনার শেখার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন। মনে রাখবেন, নিয়মিত অনুশীলন এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাই হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
YouTube Thumbnail Image: