শিয়ালদহ রেল বিভাগে শর্টকাটের নেশায় বাড়ছে ভয়াবহ অঘটন, যা প্রতি বছর হাজারো জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এই দুর্ঘটনা রোধে পূর্ব রেলওয়ের শিয়ালদহ ডিভিশন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলিতে শক্তিশালী ফেন্সিং স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। যাদবপুর স্টেশন থেকে প্রথম পর্যায়ে এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে, যাতে যাত্রীরা ওভারব্রিজ বা সাবওয়ের মতো নিরাপদ পথ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার রাজীব সাক্সেনা জানিয়েছেন, এটি একটি সর্বোচ্চ অঙ্গীকার যা অসাবধানতার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধু যাত্রীদের জীবন রক্ষা হবে না, ট্রেনের চলাচলও সহজতর হবে।
শিয়ালদহ বিভাগে শর্টকাট অঘটনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা একটি গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালে হাওড়া ও শিয়ালদহ এসআরপি’র আওতাধীন স্টেশনগুলিতে প্রায় আড়াই হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার বেশিরভাগই অবাধ পারাপারের কারণে। এই অঘটনগুলি শুধুমাত্র যাত্রীদের জন্যই নয়, ট্রেনের গতি ও সময়সূচীকেও প্রভাবিত করছে। রেল কর্তৃপক্ষের মতে, যাত্রীরা কয়েক মিনিট সময় বাঁচাতে রেললাইন পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, যা প্রায়শই মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। এই প্রবণতা রোধে ফেন্সিং স্থাপন একটি কার্যকরী সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শিয়ালদা-বনগাঁ লাইনে AC লোকাল ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে, জেনে নিন স্টপেজ ও ভাড়ার বিস্তারিত তথ্য
পূর্ব রেলওয়ের শিয়ালদহ ডিভিশন এই অভিযানকে ‘সেফটি ফার্স্ট’ নীতির অংশ হিসেবে চালু করেছে। ফেন্সিংয়ের কাজ প্রধানত প্ল্যাটফর্মের প্রান্তভাগ এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীভূত। যাদবপুর স্টেশনে প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে শক্তিশালী ধাতব বাধা স্থাপন করা হচ্ছে যাতে কেউ লাইনে প্রবেশ করতে না পারেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যাত্রীদের নির্দিষ্ট পথ—যেমন ফুট ওভারব্রিজ বা সাবওয়ে—ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি শুধুমাত্র অস্থায়ী নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ।
ডিআরএম রাজীব সাক্সেনা এই উদ্যোগ নিয়ে বলেছেন, “নিরাপত্তা শুধুমাত্র অগ্রাধিকার নয়, এটি আমাদের সর্বোচ্চ অঙ্গীকার। এই বেড়া স্থাপন একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যা মুহূর্তের অসাবধানতার কারণে ঘটে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় দুর্ঘটনা রোধ করবে।” তিনি যাত্রীদের আবেদন জানিয়েছেন, “কয়েক মিনিট বাঁচাতে নিজের মূল্যবান জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না। নিরাপদ অবকাঠামো ব্যবহার করুন।” এই বক্তব্যগুলি শিয়ালদহ ডিভিশনের অফিসিয়াল বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী বছরগুলিতে শিয়ালদহ এলাকায় শর্টকাট অঘটনের কারণে বেশ কয়েকটি করুণ ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে এই বিভাগে কয়েকশো মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা রেল সুরক্ষা বাহিনীর রিপোর্টে উল্লেখিত। এই সমস্যা শুধুমাত্র কলকাতার মতো বড় শহরেই নয়, আশেপাশের জেলাগুলিতেও বিস্তৃত। রেল মন্ত্রকের নির্দেশে পূর্ব রেলওয়ে এখন ফেন্সিংয়ের পাশাপাশি সচেতনতা অভিযান চালাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও যাত্রীরা এই ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ (পূর্বে টুইটার) শিয়ালদহ রেলওয়ের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছু পোস্ট দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবহারকারী কানক দেবনাথ লিখেছেন, “শিয়ালদহ সাউথ সেকশনের প্ল্যাটফর্ম অস্বাস্থ্যকর এবং অবৈধ বিক্রেতাদের দখলে, যা রাশ ঘণ্টায় নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।” আরেক পোস্টে প্রিয়জিৎ দেবনাথ নিউ গাড়িয়া স্টেশনের সমস্যা তুলে ধরেছেন, যেখানে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই পোস্টগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে সাধারণ যাত্রীরা এই অভিযানকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
ফেন্সিং স্থাপনের কাজ শুধুমাত্র শিয়ালদহ সীমিত নয়, এটি পুরো বিভাগের জন্য একটি বড় পরিবর্তন। যাদবপুরের পর পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য স্টেশনে এই কাজ বিস্তারিত হবে, যেমন হালিশহর বা কৃষ্ণনগর লাইনের সংবেদনশীল এলাকায়। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই বাধাগুলি ধাতব এবং দীর্ঘস্থায়ী, যা পশু বা মানুষের অননুমোদিত প্রবেশ রোধ করবে। এছাড়া, আরপিএফ (রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স) এবং জিআরপিআই (গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ) মিলে নিয়মিত পাহারা বাড়ানো হবে। এই সমন্বিত প্রচেষ্টা অঘটনের হার কমাতে সাহায্য করবে।
শিয়ালদহ-দমদম শাখায় ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণে বাতিল শনি-রবিবার ২৭টি লোকাল ট্রেন
শিয়ালদহের মতো ব্যস্ত রেল জংশনগুলিতে এই ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা হয়ে আসছে। পূর্ববর্তী ঘটনায় দেখা গেছে, শর্টকাটের কারণে ট্রেনের গতি কমে যাওয়া এবং দেরি হওয়া সাধারণ ব্যাপার। এখন ফেন্সিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের নিরাপদ পথে চালিত করা হবে, যা ট্রেনের সময়সূচীকে আরও নির্ভরযোগ্য করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ ভারতীয় রেলের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যাত্রীদের মধ্যে এই উদ্যোগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি অসুবিধা সৃষ্টি করবে, কিন্তু অধিকাংশই নিরাপত্তার পক্ষে। একজন স্থানীয় যাত্রী বলেছেন, “শর্টকাট করতে গিয়ে অনেকে জীবন হারিয়েছে, এখন ফেন্সিং এলে সচেতন হব।” সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এই বিষয়ে আলোচনা চলছে, যেখানে রেলওয়ের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টগুলি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পোস্ট করছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিআরএম শিয়ালদহের এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, “সেলফি তোলার জন্য ট্র্যাকে না যান, এটি মারাত্মক হতে পারে।”
এই ফেন্সিং অভিযান শিয়ালদহ বিভাগের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দেবে। প্রথম পর্যায় শেষ হলে অন্যান্য স্টেশনে বিস্তার ঘটবে, যা অঘটনের হার কমাতে সাহায্য করবে। রেল কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হলো ‘জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’ অর্জন, যা যাত্রীদের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে এই মডেল অন্যান্য বিভাগেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই উদ্যোগ শিয়ালদহের যাত্রীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো, যা শর্টকাটের নেশা ভাঙতে সাহায্য করবে এবং জীবন রক্ষা করবে।











