স্ট্যাচু অব লিবার্টি—যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই ভাস্কর্যটি নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে। ফ্রান্সের একজন প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। ১৮৮৬ সালে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দেওয়া এই মূর্তি নিয়ে এমন দাবি উঠেছে যে, আমেরিকা আর এই ভাস্কর্যের মূল মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারছে না। ফরাসি এমপি রাফায়েল গ্লাকসম্যানের এই মন্তব্য বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত ১৬ মার্চ, ২০২৫ তারিখে একটি জনসমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গ্লাকসম্যান এই দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, “স্ট্যাচু অব লিবার্টি যে স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলাম, বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন সে মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।” তার মতে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন সরকারের নীতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এই ভাস্কর্যের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি আরও যোগ করেন, “যুক্তরাষ্ট্র এখন সৈরাচারী শাসনের দিকে ঝুঁকছে, তাই এই প্রতীক ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনা উচিত।” এই মন্তব্যের পর থেকেই ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গ্লাকসম্যান একজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করে আসছেন। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তে তিনি ক্ষুব্ধ। গ্লাকসম্যানের যুক্তি, এই ধরনের নীতি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি এমনকি ফরাসি সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে, আমেরিকান গবেষকদের ফ্রান্সে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হোক, যাতে তারা ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি থেকে মুক্তভাবে কাজ করতে পারেন।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের একটি বড় নিদর্শন। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ফরাসি শিল্পী ফ্রেডেরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। এটি নিউইয়র্কের লিবার্টি দ্বীপে স্থাপিত হয় এবং তখন থেকে এটি অভিবাসীদের জন্য আশার প্রতীক হয়ে ওঠে। ভাস্কর্যটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেল, যিনি পরে আইফেল টাওয়ারের নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এই উপহারের মাধ্যমে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।
বর্তমানে এই দাবির প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক বিবৃতি, যা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গ্লাকসম্যানের অবস্থান জোরদার করতে সাহায্য করবে। তবে কেউ কেউ বলছেন, এটি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে সাধারণ আমেরিকানদের জন্য এই ভাস্কর্যটি তাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ, তাই এটি ফেরত দেওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না।
এই ঘটনা শুধু রাজনৈতিক বিতর্কই নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রশ্নও তুলেছে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি কেবল একটি ভাস্কর্য নয়, এটি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতীক। ফ্রান্সের দাবি যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন আলোচনার সূচনা করতে পারে। তবে বাস্তবতার নিরিখে এটি ফেরত দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে।
সবশেষে, এই দাবি ফ্রান্সের জনগণের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ গ্লাকসম্যানের সঙ্গে একমত হয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি এই প্রতীকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার অনেকে মনে করেন, এটি একটি অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব, যা দুই দেশের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারে। যাই হোক, এই বিতর্ক শিগগিরই থেমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।