Balochistan independence movement: পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের ৪৪ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত বালুচিস্তান, যে প্রদেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও দশক পর দশক ধরে চরম বঞ্চনার শিকার। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান কর্তৃক জোরপূর্বক অধিগ্রহণের পর থেকেই এই এলাকার অধিবাসীরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। পৃথক জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, সম্পদের শোষণ এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণের মতো কারণগুলি বালুচদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিয়ত জ্বালিয়ে রেখেছে। একটি গর্বিত, স্বাধীনচেতা জাতি যারা কোনোদিন পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ হিসেবে স্বীকার করেনি, তারা কি কখনো স্বাধীন হতে পারবে?
বালুচিস্তানের ঐতিহাসিক পটভূমি
ব্রিটিশ শাসনামলে বালুচিস্তান ছিল একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল। ব্রিটিশরা বালুচদের সম্পর্কে একটি বিশেষ নীতি অনুসরণ করতেন: “পাঞ্জাবিদের শাসন করো, সিন্ধিদের ভয় দেখাও, পশতুদের টাকা দিয়ে কিনে নাও, আর বালুচদের সম্মান করো।” এর কারণ ছিল বালুচদের স্বাধীনচেতা চরিত্র এবং তাদের গর্বিত জাতিসত্তা।
ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় ১৯৪৭ সালে বালুচিস্তানের তৎকালীন শাসক খুদাদদ খান ওরফে কালাতের খান স্বাধীন থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জম্মু-কাশ্মীরের মতো বালুচিস্তানও কোনো দেশের সাথে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে থাকতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারও বালুচিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বালুচিস্তান আক্রমণ করে খানকে গ্রেফতার করে এবং জোরপূর্বক অধিগ্রহণপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এরই প্রতিবাদে প্রিন্স আগা আবদুল করিম বালুচ বিদ্রোহ করেন, যা বালুচিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করে।
বালুচিস্তান কেন স্বাধীনতা চায়? মূল কারণসমূহ
ঐতিহাসিক অন্যায় ও জোরপূর্বক দখল
বালুচিস্তানের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মূল কারণগুলির মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ঐতিহাসিক অন্যায়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান জোরপূর্বক বালুচিস্তান দখল করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও বালুচিস্তান অধিগ্রহণে রাজি ছিলেন না, কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বল প্রয়োগ করে এই অঞ্চল দখল করে নেয়।
কিছু ইতিহাসবিদের মতে, যদি নেহরু বালুচিস্তানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতেন, তাহলে পাকিস্তানের আয়তন অনেক কমে যেত এবং তারা দুর্বল হয়ে থাকত। এই ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি বালুচদের মনে আজও জ্বলজ্বল করছে।
পৃথক জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও পরিচয়
বালুচিস্তানে প্রধানত বালুচ, পাশতুন এবং অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। এই সম্প্রদায়গুলির নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-পরম্পরা ও পরিচিতি রয়েছে। তারা কখনোই নিজেদের পাকিস্তানি হিসেবে স্বীকার করে না। এবং পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ বলে মনে করে না।
বালুচরা সহজাতভাবেই স্বাধীনচেতা ও গর্বিত জাতি। ব্রিটিশরা তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতেন। এজন্যই তারা বালুচদের সম্মান করতেন। কিন্তু পাকিস্তানে আসার পর তারা শুধুমাত্র শোষণের শিকার হয়েছে।
সম্পদের শোষণ ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা
বালুচিস্তান খনিজ সম্পদে ভরপুর। পাকিস্তান এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্যাস, খনি ইত্যাদি থেকে অর্থ আয় করলেও এই অঞ্চলের উন্নয়নে নজর দেয় না। বেকারি, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বালুচদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
কেন্দ্রীয় বাজেটেও বালুচিস্তানের জন্য সবচেয়ে কম বরাদ্দ করা হয়। পাকিস্তান সরকার এই এলাকাকে শুধুমাত্র সম্পদের উৎস হিসেবেই দেখে, সেখানে বসবাসকারী মানুষের কল্যাণে কোনো আগ্রহ দেখায় না।
রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও অত্যাচার
বালুচিস্তান কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনীর হাতে রাজনৈতিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। গত ১০ বছরে এখানে ৬ জন মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।
বালুচিস্তানে এখন যে প্রাদেশিক প্রশাসন আছে, তা আসলে সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল মাত্র। জনগণের আস্থা এই সরকারের প্রতি নেই। এই অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলি, যারা তরুণদের নিজেদের দলে টানতে সক্ষম হচ্ছে।
বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস
পাকিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বালুচিস্তানেই, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালে। বেলুচিস্তানের প্রিন্সলি স্টেটগুলির মধ্যে তিনটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যোগ দিলেও, কালাতের খান আহমদ ইয়ার খান প্রথমে পাকিস্তানে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি পাকিস্তানে যোগ দেন, তখন তার ভাই প্রিন্স আগা আবদুল করিম বালুচ বিদ্রোহ করেন।
সময়ের সাথে সাথে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে, যেমন বালুচ লিবারেশন আর্মি, বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট, এবং মজিদ ব্রিগেড। এসব সংগঠন সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
২০০৬ সালে বালুচ আদিবাসী নেতা নবাব আকবর খান বুগতিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করার পর আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এর আগে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও বালুচিস্তান স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ
বালুচিস্তানে বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থির। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মির সংঘাত নিত্যদিনের ঘটনা। এই সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও বালুচিস্তানের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত বলে মনে করা হয়।
স্বাধীন বালুচিস্তানের জন্য প্রতিবেশী দেশ ইরান ও আফগানিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু এই দেশগুলি কখনোই বালুচিস্তানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করবে না, কারণ তাতে তাদের নিজেদের দেশের বালুচরাও স্বাধীন বালুচিস্তানে যোগ দিতে চাইবে।
বালুচ আন্দোলনের নেতৃত্বও বহু ধারায় বিভক্ত। নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র এবং বালুচিস্তানে বা পাকিস্তানের ভেতরে তাদের তেমন কোনো বড় নেতা নেই। ফলে বালুচদের আন্দোলনে কোনো অভিন্ন কর্মসূচিও নেই।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে বাড়তে থাকা ব্যবধান থেকে আত্মঘাতী হামলার মতো হিংসাত্মক ঘটনা বাড়ছে। বালুচরা মনে করেন যে রাষ্ট্র তাদের সাথে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করে না, যা তাদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বালুচিস্তান স্বাধীনতার পথে বাধাসমূহ
বালুচিস্তানের স্বাধীনতার পথে অনেক বাধা রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব: বালুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন খুবই সীমিত। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলি এ ব্যাপারে নিরব।
- প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ: ইরান এবং আফগানিস্তানেও বালুচদের বসবাস রয়েছে। এই দেশগুলি কখনোই চাইবে না যে পাকিস্তানের বালুচিস্তান স্বাধীন হোক, কারণ তাহলে তাদের দেশের বালুচরাও স্বাধীনতার দাবি তুলবে।
- বিভক্ত নেতৃত্ব: বালুচ আন্দোলনের নেতৃত্ব একত্রিত নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে লড়াই করছে, যার ফলে তাদের শক্তি বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
- পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শক্তি: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বালুচ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করছে।
বালুচিস্তান কেন স্বাধীনতা চায় তার মূলে রয়েছে একটি জাতির অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, ঐতিহাসিক অন্যায়, সম্পদের অবৈধ শোষণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। বালুচদের এই লড়াই শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য নয়, বরং তাদের নিজস্ব পরিচয়, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যও।
বালুচিস্তানের পরিস্থিতি একদিকে যেমন বালুচ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অপমানবোধের প্রতিফলন, অন্যদিকে তাদের সম্পদের প্রতি দেশি ও বিদেশি শাসক ও পুঁজিপতিদের লোভেরও পরিচায়ক। পৃথিবীর আরও অনেক অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে এবং এক ভয়াল জনপদে পরিণত হয়েছে।
১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া বালুচদের স্বাধীনতার লড়াই আজও অব্যাহত আছে। বালুচ জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে, কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন করা কতটা সহজ হবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কখনো সহজে নিভে যায় না – বালুচিস্তানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।