SFI new president 2025: কেরলের কোঝিকোড়ে অনুষ্ঠিত ১৮তম সর্বভারতীয় সম্মেলনে সৃজন ভট্টাচার্য স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই)-এর নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। রবিবার ২৯ জুন শেষ হওয়া তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। সর্বভারতীয় সভাপতি পদে দায়িত্ব পেয়েছেন কেরলের আদর্শ এম সাজি।
বিদায়ী সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস এবং সভাপতি ভিপি সানুর পর নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন সৃজন ও সাজি। গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে দীর্ঘ জল্পনার অবসান ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এসএফআই-এর ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, যেখানে সাধারণত বাংলা থেকেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
সৃজন ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যতিক্রমী পথে। ক্যাম্পাস রাজনীতি থেকে নয়, বরং কলকাতার গোলপার্ক অঞ্চলে স্কুল স্তরে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ২০০৭ সালে স্কুল ছাত্র হিসেবে এসএফআই-তে যোগ দেওয়া এই নেতা পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত হন।
১২ মে ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার হলতু এলাকায় জন্মগ্রহণকারী সৃজনের পারিবারিক পটভূমিও রাজনৈতিক। তার পিতা ডা. অরিন্দম ভট্টাচার্য এবং মাতা স্বর্গীয় সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য উভয়েই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার দাদু অচিন্ত্য ভট্টাচার্য ছিলেন আসামের একজন কমিউনিস্ট নেতা, যিনি সিপিআই থেকে বেরিয়ে সিপিএম গঠনের প্রাথমিক কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন।
ছাত্র নেতা হিসেবে সৃজনের উত্থান ছিল ক্রমান্বয়িক। ২০১৫ সালে এসএফআই কলকাতা জেলা কমিটির সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং একই বছর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি এসএফআই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। তার সাথে রাজ্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রতীক উর রহমান।
সৃজনের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ এসএফআই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, যার ফলে যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশক পর ছাত্র ইউনিয়ন ফিরে আসে। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে তিনি সারা রাজ্য জুড়ে ছাত্রদের সংগঠিত করেন।
কোভিড মহামারী চলাকালে সৃজন ও প্রতীকের নেতৃত্বে এসএফআই ডিজিটাল বিভাজন নিয়ে সোচ্চার ছিল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলার জন্য সফল আন্দোলন পরিচালনা করে, যার ফলে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে বাধ্য হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এর বিরুদ্ধেও তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং এর বিকল্প হিসেবে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নেও ভূমিকা রাখেন।
নির্বাচনী রাজনীতিতেও সৃজনের অংশগ্রহণ রয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হুগলির সিঙ্গুর কেন্দ্র থেকে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু তৃতীয় স্থান অর্জন করে ১৪.৩% ভোট পেয়ে হেরে যান। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও যাদবপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন কিন্তু সাযনী ঘোষ ও অনির্বাণ গাঙ্গুলীর কাছে পরাজিত হন।
এসএফআই-এর ইতিহাসে বাংলার নেতাদের প্রাধান্য একটি লক্ষণীয় বিষয়। বিমান বসু থেকে শুরু করে সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী এবং ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় – সবাই বাঙালি নেতা ছিলেন। তবে কখনো কখনো এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। যেমন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর হিমাচল প্রদেশের বিক্রম সিংহ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এখন আবার সেই ধারা ফিরে এসেছে সৃজনের মাধ্যমে।
সৃজন কেবল একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও। ‘এবং কয়েকজন’ নামের একটি মিউজিক্যাল ব্যান্ডের সাথে যুক্ত থেকে তিনি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে এই ব্যান্ড ৯টি মৌলিক রচনা নিয়ে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এছাড়াও ২০২১ সালের কলকাতা বইমেলায় ‘পরিত্যক্ত ক্যারাভ্যানের গান’ নামে তার কবিতা ও ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ এসএফআই-এর রাজ্য সম্মেলনে সৃজন ও প্রতীকের স্থলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। কলকাতার দেবাঞ্জন দে রাজ্য সম্পাদক এবং কোচবিহারের প্রণয় কার্যী রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন। তখনই গুঞ্জন ছিল যে সৃজন এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেতে পারেন।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে এসএফআই-এর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ ৩১ হাজার, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে আরজি কর আন্দোলনের প্রভাবে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এসএফআই-এর সদস্যসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দুই হাজার ছাড়িয়েছে।
১৯৭০ সালে তিরুবনন্তপুরমে প্রতিষ্ঠিত এসএফআই আজ দেশের অন্যতম বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। ‘স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’-এর স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলা এই সংগঠনের আন্তর্জাতিক শাখাও রয়েছে। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে এসএফআই-ইউকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সৃজনের নতুন দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জও কম নয়। দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন, শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ এবং ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তার সংযত ভাষা, মার্জিত আচরণ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব এই দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সিপিএমের একটি অংশের ধারণা, ২০২৬ সালের নির্বাচনে আবারও যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সৃজনকে প্রার্থী করা হতে পারে। তবে এখন তার মূল মনোযোগ থাকবে সর্বভারতীয় দায়িত্বে। দিল্লিতে বেশি সময় কাটাতে হবে তাকে। এই নতুন দায়িত্বে সৃজনের সাফল্য নির্ভর করবে তিনি কীভাবে দেশব্যাপী বাম ছাত্র আন্দোলনকে নতুন দিকে পরিচালিত করতে পারেন এবং নতুন প্রজন্মকে সংগঠিত করতে পারেন।