Bengali typing software evolution: আজ আমরা যখন কম্পিউটারে বা মোবাইলে বাংলা ভাষায় সহজে লিখতে পারি, তখন হয়তো খুব কম মানুষই জানেন যে এই সুবিধার পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ পথচলা। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই যাত্রার শুরুটা কোথায় হয়েছিল? আজকের এই লেখায় আমরা ফিরে যাব সেই হারিয়ে যাওয়া একটি গল্পে—শহীদলিপি (Shahidlipi), বাংলা ভাষার প্রথম কম্পিউটার কিবোর্ডের গল্পে। এটি কেবল একটি কিবোর্ড ছিল না, এটি ছিল বাংলা ভাষার ডিজিটাল জগতে প্রবেশের প্রথম সিঁড়ি। তাহলে চলুন, সময়ের পাতা উল্টে দেখি সেই অজানা ইতিহাস, যা বাংলা ভাষাকে কম্পিউটারের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শহীদলিপি ছিল বাংলা ভাষার জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার কিবোর্ড লে-আউট এবং সফটওয়্যারের একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। এটি এমন একটি সময়ে এসেছিল যখন কম্পিউটারে বাংলা লেখা ছিল প্রায় অসম্ভব। আজ আমরা অভ্র (Avro) বা গুগলের বাংলা কিবোর্ডে যে সহজে লিখি, তার পেছনে শহীদলিপির মতো উদ্যোগের অবদান অনস্বীকার্য। এটি কেবল একটি টুল ছিল না, বরং বাংলা ভাষার ডিজিটাল রূপান্তরের পথিকৃৎ। এই কিবোর্ডটির নামকরণ করা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সম্মানে, যা এর পেছনের গভীর আবেগ আর উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে।
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে যখন কম্পিউটার বাংলাদেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন বাংলা ভাষায় কাজ করার জন্য কোনো সঠিক ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজি কিবোর্ডে বাংলা লেখার জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি সিস্টেম, যা বাংলা অক্ষরগুলোকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করতে পারে এবং স্ক্রিনে দেখাতে পারে। শহীদলিপি এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এসেছিল, এবং এটিই ছিল বাংলা কম্পিউটিংয়ের প্রথম সফল পদক্ষেপ।
ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড ভুলে গেলেও বের করে ফেলুন এক ক্লিকে : [Step-by-Step Wifi Password Guide]
আমাদের গল্প শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে, যখন বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম কম্পিউটার আসে। ১৯৬৪ সালে ঢাকার পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে আইবিএম-১৬২০ সিরিজের একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার স্থাপিত হয়। কিন্তু এই কম্পিউটারে বাংলা লেখার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন কম্পিউটার মানে ছিল ইংরেজি আর গাণিতিক হিসাবের যন্ত্র। বাংলা ভাষার জটিল অক্ষর, যুক্তাক্ষর এবং বিন্যাস তৎকালীন প্রযুক্তির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
এর আগে, ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী টাইপরাইটারের জন্য একটি বাংলা কিবোর্ড লে-আউট তৈরি করেছিলেন, যা ‘মুনীর লে-আউট’ নামে পরিচিত। এটি ছিল QWERTY কিবোর্ডের ভিত্তিতে তৈরি এবং টাইপিংয়ের গতি বাড়ানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। তবে এটি টাইপরাইটারের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল। কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য শুধু লে-আউট যথেষ্ট ছিল না—প্রয়োজন ছিল সফটওয়্যার এবং ফন্টের।
১৯৮৭ সালে এই চ্যালেঞ্জের সমাধান নিয়ে এলেন মোস্তফা জব্বার। তিনি ছিলেন একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী। তার হাত ধরেই জন্ম নিল শহীদলিপি। এটি ছিল একটি ফনেটিক লে-আউট, যা QWERTY কিবোর্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এর মাধ্যমে বাংলা অক্ষরগুলো ইংরেজি কিবোর্ডে টাইপ করা যেত, এবং একটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেগুলো বাংলা ফন্টে রূপান্তরিত হতো। শহীদলিপির প্রথম সংস্করণে প্রায় ১৮২টি বাংলা বর্ণ ও যুক্তাক্ষর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা তৎকালীন সময়ে একটি বিপ্লবী উদ্ভাবন।
মোস্তফা জব্বারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল জগতে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভাষা যদি প্রযুক্তির সঙ্গে না মিশে, তবে তা পিছিয়ে পড়বে। শহীদলিপির নামকরণে তিনি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, যারা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন।
শহীদলিপি ছিল একটি সমন্বিত সিস্টেম। এটির মূল অংশ ছিল তিনটি—কিবোর্ড লে-আউট, সফটওয়্যার এবং ফন্ট। এটি ফনেটিক পদ্ধতিতে কাজ করতো, অর্থাৎ বাংলা শব্দের উচ্চারণ অনুযায়ী ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করলে সফটওয়্যার সেটিকে বাংলায় রূপান্তর করতো। উদাহরণস্বরূপ, “ami” লিখলে সেটি “আমি” হয়ে যেত। এই সিস্টেমটি তৎকালীন MS-DOS অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করতো। পরবর্তীতে, উইন্ডোজ সংস্করণও বাজারে আসে, যা এর ব্যবহারকে আরও প্রসারিত করে।
শহীদলিপির সফটওয়্যারটি বাংলা অক্ষর প্রক্রিয়াকরণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে বাংলা ফন্ট প্রদর্শন করতে পারতো, যা তখনকার সময়ে একটি বড় অর্জন। এই ফন্টটি ছিল সহজ এবং পড়তে আরামদায়ক, যা ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
শহীদলিপি বাংলা ভাষার ডিজিটাল বিপ্লবের প্রথম ধাপ ছিল। এটি প্রকাশনা শিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং বইয়ের প্রকাশনায় বাংলা টাইপ করার জন্য শহীদলিপি ব্যবহৃত হতো। এর ফলে বাংলা ভাষায় কম্পিউটার ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের অনেক প্রকাশনা সংস্থা এই সফটওয়্যারের উপর নির্ভর করতো।
এছাড়া, শহীদলিপি অন্যান্য বাংলা কিবোর্ড লে-আউটের জন্য পথ দেখিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিজয় (Bijoy) এবং অভ্র (Avro) কিবোর্ডের উদ্ভাবনেও শহীদলিপির প্রভাব লক্ষণীয়। এটি প্রমাণ করেছিল যে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে ব্যবহারযোগ্য এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত শহীদলিপি বাংলাদেশে বাংলা কম্পিউটিংয়ের প্রধান হাতিয়ার ছিল। এটি ব্যবহার করা হতো সরকারি দপ্তরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ব্যক্তিগত কাজে। তৎকালীন সময়ে যারা কম্পিউটারে বাংলা লিখতে চাইতেন, তাদের কাছে শহীদলিপি ছিল একমাত্র ভরসা। মোস্তফা জব্বারের প্রচেষ্টায় এটি বাণিজ্যিকভাবেও বাজারে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি বদলাতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিজয় কিবোর্ড বাজারে আসে, যা শহীদলিপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। বিজয় আরও উন্নত ফিচার এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেস নিয়ে আসে। এরপর ২০০৩ সালে অভ্র কিবোর্ডের আবির্ভাব হয়, যা ইউনিকোড প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। অভ্র বিনামূল্যে পাওয়া যেত এবং এটি ইন্টারনেটে বাংলা লেখার জন্য আরও উপযোগী ছিল।
শহীদলিপি এই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। এটি ইউনিকোড সমর্থন করতো না, যা আধুনিক কম্পিউটিংয়ের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। ফলে ধীরে ধীরে এটি ব্যবহারকারীদের কাছে পুরনো প্রযুক্তি হিসেবে গণ্য হতে থাকে এবং হারিয়ে যায়।
শহীদলিপি হয়তো আজ আর ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু এর অবদান ভোলার নয়। এটি বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করার প্রথম সফল প্রয়াস ছিল। আজ আমরা যে অভ্র বা গুগল কিবোর্ড ব্যবহার করি, তার পেছনে শহীদলিপির মতো প্রাথমিক উদ্যোগের ভূমিকা অনেক। এটি প্রমাণ করেছিল যে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে শুধু লেখা যায় না, বরং এটি প্রকাশনা, শিক্ষা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য।
বাংলা ভাষা ও পরিচয়ের রাজনীতি: ‘Bengal’, ‘Bangla’ ও ‘Bohiragoto’-এর টানাপোড়েন
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে শহীদলিপি হয়তো একটি অজানা নাম। কিন্তু এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তির প্রতিটি অগ্রগতির পেছনে রয়েছে কিছু অগ্রদূতের ত্যাগ আর পরিশ্রম। শহীদলিপির গল্প আমাদের শেখায় যে, কোনো ভাষা বা সংস্কৃতি তখনই টিকে থাকে, যখন তা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
শহীদলিপি হয়তো সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে, কিন্তু এটি বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার প্রথম পদচিহ্ন। এটি ছিল একটি স্বপ্ন, যা মোস্তফা জব্বারের হাতে বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। আজ আমরা যখন ইন্টারনেটে বাংলায় লিখি, যখন আমাদের মনের ভাব বাংলায় প্রকাশ করি, তখন শহীদলিপির সেই প্রথম প্রচেষ্টার কথা মনে পড়ে। এটি কেবল একটি কিবোর্ড ছিল না, এটি ছিল বাংলা ভাষার গৌরব ও সম্ভাবনার প্রতীক। তাই শহীদলিপি হারিয়ে যাওয়া গল্প নয়, বরং একটি নতুন যুগের সূচনা, যা আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে।