সাড়ে সাতি থেকে মুক্তির আশায় কোন শনি মন্দিরগুলি এই বছর আপনার অবশ্যই দর্শন করা উচিত?

জ্যোতিষশাস্ত্রে শনিদেবকে (Lord Shani) বলা হয় 'কর্মফলদাতা' বা ন্যায়দণ্ডধারী। তিনি মানুষের ভালো-মন্দ কাজের সূক্ষ্ম বিচার করেন এবং সেই অনুযায়ী ফল প্রদান করেন। এই কারণেই শনি গ্রহের অবস্থান পরিবর্তন বা 'গোচর'…

Pandit Subhas Sastri

 

জ্যোতিষশাস্ত্রে শনিদেবকে (Lord Shani) বলা হয় ‘কর্মফলদাতা’ বা ন্যায়দণ্ডধারী। তিনি মানুষের ভালো-মন্দ কাজের সূক্ষ্ম বিচার করেন এবং সেই অনুযায়ী ফল প্রদান করেন। এই কারণেই শনি গ্রহের অবস্থান পরিবর্তন বা ‘গোচর’ (Transit) প্রতিটি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। আর ঠিক এই কারণেই ২০২৫ সাল জ্যোতিষশাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে চলেছে। মহাগোচর কিছু রাশির জাতকদের জন্য শনির সাড়ে সাতির (Sade Sati) প্রকোপ থেকে মুক্তির বার্তা আনবে, আবার কিছু রাশির জন্য নতুন করে এই প্রভাব শুরু হবে। যখন জীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়, তখন ভক্তরা শনিদেবের আশীর্বাদ পেতে এবং তার অশুভ প্রভাব প্রশমিত করতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শক্তিশালী শনি মন্দিরগুলিতে ভিড় জমান। এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র সেই মন্দিরগুলির একটি তালিকা নয়, বরং ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে কেন এই মন্দিরগুলি দর্শন করা আপনার জন্য অপরিহার্য, তার একটি সম্পূর্ণ এবং গভীর বিশ্লেষণ।

ভারতের আধ্যাত্মিক পর্যটনের মানচিত্র বিশাল এবং বৈচিত্র্যময়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এই ধর্মীয় পর্যটন (Religious Tourism) দেশের অর্থনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট ব্যাঙ্গালোর (IIM Bangalore)-এর একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, ২০২২ সালে ভারতে ধর্মীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১.৪৩৯ বিলিয়ন (প্রায় ১৪৪ কোটি) এবং এই খাত থেকে অর্থনীতিতে অবদান ছিল প্রায় ₹১.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। কোভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। শনিদেবের মন্দিরগুলি এই আধ্যাত্মিক পর্যটনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা কেবল বিশ্বাস বা ভক্তির কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকার সাথেও জড়িত।

২০২৬ কেন শনি উপাসনার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ?

প্রতিটি গ্রহই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাশি পরিবর্তন করে। শনি সবচেয়ে ধীর গতিসম্পন্ন গ্রহ, এটি একটি রাশিচক্র সম্পূর্ণ করতে প্রায় ৩০ বছর সময় নেয় এবং এক একটি রাশিতে প্রায় আড়াই বছর (২.৫ বছর) অবস্থান করে। এই ধীর গতিই তার প্রভাবকে এত গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।

২০২৬ সালে কোন রাশিগুলি প্রভাবিত হবে?

এই মহাগোচরের ফলে, ২০২৬ সালে বিভিন্ন রাশির উপর শনির প্রভাব নিম্নরূপ হবে:

দশার নাম প্রভাবিত রাশি (২০২৬ ) প্রভাবের ধরণ
সাড়ে সাতি মকর রাশি (Capricorn) শেষ পর্যায় (মুক্তি)। প্রায় সাড়ে সাত বছরের কঠিন সময়কাল শেষ হতে চলেছে।
সাড়ে সাতি কুম্ভ রাশি (Aquarius) দ্বিতীয় পর্যায় (শিখর)। এই সময়টি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বলে মনে করা হয়।
সাড়ে সাতি মীন রাশি (Pisces) প্রথম পর্যায় (শুরু)। এই রাশিগুলির জন্য সাড়ে সাতির সূচনা হচ্ছে।
আড়াইয়া (কণ্টক শনি) কর্কট রাশি (Cancer) অষ্টম স্থানে শনির অবস্থানের কারণে ‘অষ্টম শনি’ বা ‘আড়াইয়া’ চলবে।
আড়াইয়া (চতুর্থ শনি) বৃশ্চিক রাশি (Scorpio) চতুর্থ স্থানে শনির অবস্থানের কারণে ‘চতুর্থ শনি’ বা ‘আড়াইয়া’ চলবে।
সাড়ে সাতি শুরু মেষ রাশি (Aries) মীন রাশিতে শনির প্রবেশের ফলে মেষ রাশির দ্বাদশ ঘরে শনির অবস্থান হবে, যা তাদের সাড়ে সাতির সূচনা করবে।

এই জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পরিবর্তনের কারণে, বিশেষত মকর, কুম্ভ, মীন এবং মেষ রাশির জাতকদের জন্য ২০২৫ সালটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে শনি মন্দির দর্শন করে তাঁর পূজা করা এবং আশীর্বাদ প্রার্থনা করাকে অশুভ প্রভাব কমানোর সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় বলে মনে করা হয়।

ভারতের ধর্মীয় পর্যটন: ভক্তি এবং অর্থনীতির মেলবন্ধন

শনি মন্দিরগুলির এই গুরুত্ব কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভারতের বৃহত্তর ধর্মীয় পর্যটন অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রক (Ministry of Tourism) ধর্মীয় স্থানগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

সরকারী উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিক প্রভাব

ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের বার্ষিক প্রতিবেদন (Annual Report 2022-23) অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের (Domestic Tourism) এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে তীর্থযাত্রা। সরকার ‘প্রসাদ’ (PRASHAD – Pilgrimage Rejuvenation and Spiritual, Heritage Augmentation Drive) স্কিমের মতো বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তীর্থস্থানগুলির পরিকাঠামো, যেমন রাস্তা, পরিচ্ছন্নতা এবং যাত্রী সুবিধা বৃদ্ধি করছে। এই প্রকল্পটি পর্যটন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে

ফোর্বস ইন্ডিয়া (Forbes India)-এর একটি বিশ্লেষণে এই “ভক্তি ও ডলারের” (Divine meets Dollars) অর্থনীতিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণের পর যেভাবে সেখানে পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে এবং পর্যটনের জোয়ার এসেছে, তা অন্যান্য ধর্মীয় স্থানগুলির জন্যও একটি মডেল হয়ে উঠছে। এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শুধুমাত্র বড় কর্পোরেশনগুলির জন্য নয়, এটি স্থানীয় স্তরে ছোট ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে।

এমনকি বিশ্বব্যাঙ্ক (World Bank) উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে “প্রো-পুওর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট”-এ সহায়তা করেছে, যার মধ্যে মথুরার মতো ধর্মীয় স্থানগুলিও অন্তর্ভুক্ত। এর উদ্দেশ্য হল পর্যটনের সুফল যাতে স্থানীয় এবং দরিদ্র সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা।

যখন ২০২৫ সালে লক্ষ লক্ষ ভক্ত শনির সাড়ে সাতি বা ঢাইয়ার প্রভাব প্রশমিত করতে এই মন্দিরগুলিতে যান, তখন তারা কেবল নিজেদের আধ্যাত্মিক শান্তিই খুঁজবেন না, বরং অজান্তেই এই চক্রাকার অর্থনীতিতে এক বিশাল অবদান রাখবেন।

প্রধান শনি মন্দির: ২০২৬ সালের অবশ্য দ্রষ্টব্য

ভারতের বিভিন্ন কোণে শনিদেবের অসংখ্য মন্দির থাকলেও, কয়েকটি মন্দির তাদের অলৌকিক ইতিহাস, পৌরাণিক গুরুত্ব এবং ভক্তদের গভীর বিশ্বাসের কারণে অনন্য হয়ে উঠেছে। ২০২৬ সালের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, এই মন্দিরগুলি দর্শন করা অপরিহার্য।

১. শ্রী শনি শিঙ্গণাপুর, মহারাষ্ট্র (Sri Shani Shingnapur, Maharashtra)

শনির মন্দিরগুলির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জাগ্রত বলে মানা হয় মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার শনি শিঙ্গণাপুরকে।

কিংবদন্তি ও ইতিহাস

শনি শিঙ্গণাপুরের উইকিপিডিয়া পৃষ্ঠা এবং লোকশ্রুতি অনুসারে, শত শত বছর আগে এক প্রবল বন্যার পর পানাশা নালার তীরে এক রাখাল একটি বিশাল কালো পাথর খুঁজে পান। তিনি কৌতুহলবশত একটি লাঠি দিয়ে পাথরটিতে আঘাত করলে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে। সেই রাতে, শনিদেব ওই রাখালের স্বপ্নে দেখা দেন এবং বলেন যে তিনিই ওই ‘স্বয়ম্ভূ’ (Swayambhu) পাথর। তিনি গ্রামে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু একটি শর্তে: তাকে কোনো ছাদের নিচে রাখা যাবে না, তিনি খোলা আকাশের নিচেই থাকবেন।

অনন্য বৈশিষ্ট্য: দরজা-বিহীন গ্রাম

শিঙ্গণাপুরের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল এখানকার কোনো বাড়িতে দরজা বা তালা নেই। এমনকি ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসেও তালা লাগানো হয় না। গ্রামবাসীদের অটুট বিশ্বাস যে, শনিদেব স্বয়ং এই গ্রামকে সমস্ত বিপদ ও চর্যবৃত্তি থেকে রক্ষা করেন। এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, যদি কেউ এখানে চুরি করার চেষ্টা করে, তবে সে শনিদেবের রোষের শিকার হয় এবং গ্রাম পার হওয়ার আগেই অন্ধ হয়ে যায় বা উন্মাদ হয়ে যায়। এই জীবন্ত বিশ্বাসই লক্ষ লক্ষ ভক্তকে এখানে টেনে আনে।

পূজার নিয়মাবলী ও দর্শন (Darshan Rules)

মন্দিরটি ভক্তদের জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এখানে শনিদেব একটি পাঁচ ফুট উঁচু কালো পাথর রূপে পূজিত হন, যার উপরে কোনো ছাদ নেই।

  • স্নান: পূজার আগে ভক্তদের মন্দিরের স্নানাগারে পবিত্র স্নান সম্পন্ন করতে হয়। পুরুষদের শুধুমাত্র একটি ভেজা কাপড় (সাধারণত গেরুয়া বা সাদা) পরেই গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি ছিল।
  • অভিষেক: পূর্বে ভক্তরা সরাসরি বিগ্রহের উপর সর্ষের তেল (Mustard Oil) ঢালতে পারতেন। তবে, ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং বিগ্রহের সুরক্ষার জন্য, বর্তমানে মন্দির ট্রাস্ট একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তেল সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে, যা পাম্পের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিগ্রহের উপর অভিষেক করা হয়।
  • শনি অমাবস্যা: শনি অমাবস্যা (শনিবারের অমাবস্যা) এবং শনি জয়ন্তীতে এখানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়।

কিভাবে যাবেন (How to Reach)

  • বিমানবন্দর: নিকটতম বিমানবন্দর হল ঔরঙ্গাবাদ (প্রায় ৯০ কিমি) এবং পুনে (প্রায় ১৬০ কিমি)।
  • রেলপথ: নিকটতম প্রধান রেল স্টেশন হল আহমেদনগর (প্রায় ৩৫ কিমি) এবং শিরডি (প্রায় ৭০ কিমি)।
  • সড়কপথ: শিরডি থেকে শিঙ্গণাপুর নিয়মিত বাস ও ট্যাক্সি পরিষেবা রয়েছে। অনেক ভক্ত শিরডি সাইবাবার দর্শন করে তারপর শিঙ্গণাপুরে আসেন।

২. তিরুনাল্লার শনিশ্বরন মন্দির, পুদুচেরি (Thirunallar Shaneeswarar Temple, Puducherry)

যদি শিঙ্গণাপুর শনিদেবের ‘ভয়’ বা ‘ন্যায়’-এর প্রতীক হয়, তবে তামিলনাড়ু সংলগ্ন পুদুচেরির কারাইকাল জেলার তিরুনাল্লার হল শনির ‘আশীর্বাদ’ এবং ‘মুক্তি’-এর প্রতীক। এটি ভারতের একমাত্র প্রধান মন্দির যেখানে শনিদেবকে ‘অনুগ্রহকারী’ (benevolent) রূপে পূজা করা হয়।

কিংবদন্তি ও ইতিহাস: রাজা নলের মুক্তি

এই মন্দিরের গুরুত্ব পৌরাণিক রাজা নল (Nala) এবং দময়ন্তীর কাহিনীর সাথে জড়িত। কিংবদন্তি অনুসারে, রাজা নল শনির সাড়ে সাতির কবলে পড়ে তার রাজ্য, সম্পদ, এমনকি স্ত্রী-সন্তানদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েন। দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর অমানুষিক কষ্ট ভোগ করার পর, তিনি এই তিরুনাল্লার তীর্থে আসেন। এখানে এসে তিনি মন্দিরের পবিত্র কুণ্ড ‘নল তীর্থম’-এ (Nala Theertham) স্নান করেন এবং ভগবান শিব (দরবারণেশ্বর) ও শনিদেবের পূজা করেন। তার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে শনিদেব তাকে এই স্থানেই সাড়ে সাতির অভিশাপ থেকে মুক্ত করেন।

অনন্য বৈশিষ্ট্য: নল তীর্থম

এই কারণেই তিরুনাল্লারকে সাড়ে সাতি থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী স্থান বলে মনে করা হয়।

  • নল তীর্থে স্নান: এখানে পূজার প্রধান অঙ্গ হল মন্দিরের ‘নল তীর্থম’ নামক পবিত্র সরোবরে স্নান করা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এই জলে স্নান করলে শনির অশুভ প্রভাব ধুয়ে যায়।
  • বস্ত্র ত্যাগ: প্রথা অনুযায়ী, ভক্তরা স্নানের পর তাদের পরিহিত ভেজা কাপড় ওই ঘাটেই ফেলে আসেন। এটি প্রতীকীভাবে তাদের পুরনো দুর্ভাগ্য এবং কর্মফলকে পিছনে ফেলে আসার চিহ্ন।
  • তিলের প্রদীপ: স্নানের পর ভক্তরা মন্দিরে তিলের তেলের প্রদীপ (Sesame Oil Lamps) জ্বালান এবং শনিদেবকে কালো তিল (Black Sesame) নিবেদন করেন।

পূজার নিয়মাবলী ও দর্শন

মন্দিরের প্রধান দেবতা ভগবান শিব (দরবারণেশ্বর) হলেও, শনিদেবের (শনিশ্বরন) বিগ্রহটি আলাদাভাবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পূজিত হয়। ভক্তরা প্রথমে নল তীর্থে স্নান করে, তারপর শনিশ্বরন, ভগবান শিব এবং দেবী অম্বিকার (ভোগমার্থা পুন্মুল্লাই আম্মাল) পূজা করেন। শনি যখন এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন করে (শনি পেয়ারচি), তখন এখানে সবথেকে বড় উৎসব হয়, যাতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত যোগ দেন।

কিভাবে যাবেন (How to Reach)

  • বিমানবন্দর: নিকটতম বিমানবন্দর হল ত্রিচি (প্রায় ১৬০ কিমি) এবং চেন্নাই (প্রায় ৩০০ কিমি)।
  • রেলপথ: নিকটতম প্রধান রেল জংশন হল মায়িলাদুতুরাই (Mayiladuthurai) এবং কারাইকাল (Karaikal)।
  • সড়কপথ: এটি তামিলনাড়ুর কুম্ভকোণম, মায়িলাদুতুরাই এবং পুদুচেরি শহরের সাথে সড়কপথে ভালোভাবে সংযুক্ত।

৩. কোকিলাবন ধাম (শনি মন্দির), মথুরা, উত্তরপ্রদেশ (Kokilavan Dham, Mathura, UP)

উত্তরপ্রদেশের মথুরা, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত, সেখানেই রয়েছে শনিদেবের এক অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির— কোকিলাবন ধাম।

কিংবদন্তি ও ইতিহাস: কৃষ্ণ ও কোকিল

এই মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনীটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী। লোকশ্রুতি অনুসারে, যখন শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় বালকরূপে লীলা করছিলেন, তখন শনিদেব তার দর্শন পেতে মথুরায় আসেন। কিন্তু শনিদেবের ‘দৃষ্টি’-র অশুভ প্রভাবের কথা ভেবে মা যশোদা তাকে কৃষ্ণের কাছে যেতে বাধা দেন। হতাশ হয়ে শনিদেব মথুরার কাছে এক বনে (বর্তমান কোকিলাবন) কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাকে দর্শন দেন, তবে এক কোকিলের (Cuckoo) রূপে। তিনি শনিদেবকে বর দেন যে, এই বনে এসে যে ভক্ত আপনাকে পূজা করবে এবং তারপর আমার (কৃষ্ণের) পূজা করবে, সে শনির সমস্ত দশা থেকে মুক্তি পাবে।

অনন্য বৈশিষ্ট্য: কোকিলের রূপ

এই কারণেই এই স্থানটির নাম ‘কোকিলাবন’। এখানে শনিদেব এবং শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই পূজিত হন।

  • পরিক্রমা: এই মন্দিরের প্রধান আচার হল ‘কোকিলাবন পরিক্রমা’। ভক্তরা মন্দিরের চারপাশের বনভূমি পরিক্রমা করেন।
  • কৃষ্ণের দর্শন: বিশ্বাস করা হয় যে, কোকিলাবনে শনিদেবের পূজা ততক্ষণ সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না ভক্তরা সংলগ্ন শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে (যিনি ‘বাঁকে বিহারী’ নামে পরিচিত) দর্শন করেন।
  • উন্নয়নের ছোঁয়া: এই মন্দিরটি মথুরা-বৃন্দাবন ধর্মীয় সার্কিটের অংশ। বিশ্বব্যাঙ্ক (World Bank) সমর্থিত ‘ইউপি প্রো-পুওর ট্যুরিজম’ প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি এই অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করছে, যা কোকিলাবনের মতো মন্দিরগুলিতে তীর্থযাত্রীদের অভিজ্ঞতা আরও সহজলভ্য করে তুলছে।

কিভাবে যাবেন (How to Reach)

  • বিমানবন্দর: নিকটতম বিমানবন্দর হল দিল্লি (প্রায় ১৫০ কিমি) এবং আগ্রা (প্রায় ১০০ কিমি)।
  • রেলপথ: নিকটতম প্রধান রেল স্টেশন হল মথুরা জংশন (প্রায় ১০-১২ কিমি)।
  • সড়কপথ: মথুরা বা বৃন্দাবন থেকে কোসি কালান (Kosi Kalan) হয়ে সহজেই ট্যাক্সি বা অটো রিকশা যোগে কোকিলাবন পৌঁছানো যায়।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শনি মন্দির

উপরোক্ত তিনটি প্রধান মন্দির ছাড়াও, ভারতে আরও কয়েকটি শক্তিশালী শনি মন্দির রয়েছে যেগুলিও ভক্তদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. শনিচড়া মন্দির, গোয়ালিয়র, মধ্যপ্রদেশ (Shanichara Temple, Gwalior, MP)

গোয়ালিয়রের কাছে আইন্তি (Ainti) গ্রামে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরটি। লোকবিশ্বাস অনুসারে, এটিই সেই স্থান যেখানে হনুমান লঙ্কা থেকে শনিদেবকে এনে নিক্ষেপ করেছিলেন। বলা হয়, এখানে যে শিলাখণ্ডটি পূজিত হয়, তা লঙ্কা থেকে উড়ে আসা সেই উল্কাপিণ্ড। শনি অমাবস্যায় এখানে বিশাল মেলা বসে।

৫. শনি ধাম মন্দির, দিল্লি (Shani Dham Temple, Delhi)

রাজধানী দিল্লির ছত্তরপুরে অবস্থিত এই মন্দিরটি সাম্প্রতিক সময়ে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে শনিদেবের এক বিশাল মূর্তি রয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম উচ্চতম শনি মূর্তি বলে দাবি করা হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক শিলাখণ্ড হিসেবেও পূজিত হয়।

আপনার ২০২৬ সালের শনি তীর্থযাত্রা পরিকল্পনা

২০২৫ সালে যদি আপনি শনির দশা দ্বারা প্রভাবিত হন বা কেবল শনিদেবের আশীর্বাদ লাভ করতে চান, তবে আপনার তীর্থযাত্রা পরিকল্পনা করার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।

কখন যাবেন? (Best Time to Visit)

  • শনি অমাবস্যা: শনিবার যখন অমাবস্যা তিথি পড়ে, সেই দিনটিকে শনি পূজার জন্য সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়। এই দিনগুলিতে মন্দিরগুলিতে প্রচণ্ড ভিড় হয়।
  • শনি জয়ন্তী: শনিদেবের জন্মদিন (সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায়) অত্যন্ত ধুমধামের সাথে পালিত হয়।
  • গোচরের পর: যে কোনো শনিবারে এই মন্দিরগুলিতে যাওয়া বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে, কারণ এই সময়েই শনির নতুন দশা শুরু হচ্ছে।

কী কী নিবেদন করবেন? (Common Offerings)

শনিদেবকে তুষ্ট করার জন্য ভক্তরা সাধারণত নিম্নলিখিত সামগ্রী নিবেদন করেন:

  • সর্ষের তেল (Mustard Oil): শনির পূজায় এটি অপরিহার্য।
  • কালো তিল (Black Sesame Seeds): তিল দান করা বা তিলের তেলের প্রদীপ জ্বালানো হয়।
  • কালো কাপড় (Black Cloth): শনিদেবকে কালো বস্ত্র নিবেদন করা হয়।
  • লোহার সামগ্রী (Iron): লোহা শনির ধাতু। তাই ভক্তরা লোহার পেরেক বা অন্যান্য সামগ্রী দান করেন।
  • কালো উরাদ ডাল (Black Urad Dal): এটিও শনির প্রিয় সামগ্রী বলে মনে করা হয়।

সাধারণ নিয়মাবলী (General Rules)

১. বিনয়: শনিদেব কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং বিনয় পছন্দ করেন। মন্দিরে গিয়ে বিনম্র আচরণ করা এবং অহংকার ত্যাগ করা উচিত।

২. পরিচ্ছন্নতা: পূজার আগে স্নান করে পরিষ্কার (বিশেষত কালো বা নীল) বস্ত্র পরিধান করা বাঞ্ছনীয়।

৩. দান: শনিদেব ‘কর্মফলদাতা’। তাই মন্দির চত্বরে থাকা দরিদ্র, প্রতিবন্ধী বা বয়স্ক ব্যক্তিদের অর্থ, বস্ত্র বা খাদ্য দান করাকে শনিকে তুষ্ট করার অন্যতম সেরা উপায় বলে মনে করা হয়।

৪. ধৈর্য: এই মন্দিরগুলিতে, বিশেষত বিশেষ দিনগুলিতে, প্রচণ্ড ভিড় থাকে। শনিদেব ধৈর্যের পরীক্ষা নেন। তাই শান্তভাবে, ধৈর্য ধরে দর্শন করা উচিত।

শনি শিঙ্গণাপুরের দরজা-বিহীন গ্রামের অটুট বিশ্বাস, তিরুনাল্লারের নল তীর্থে দুর্ভাগ্যকে পিছনে ফেলে আসার প্রতীকী স্নান, বা কোকিলাবনে কৃষ্ণ ও শনির মিলিত উপাসনা— প্রতিটি তীর্থযাত্রাই এক একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। এই মন্দিরগুলি দর্শন করা কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়; এটি নিজের কর্মের প্রতি সচেতন হওয়া, ধৈর্য ধারণ করা এবং ন্যায়ের দেবতার কাছে বিনম্রভাবে আত্মসমর্পণ করার একটি প্রক্রিয়া। ২০২৫ সালে আপনার এই যাত্রা হোক মঙ্গলময় ও শান্তিদায়ক।

About Author
Pandit Subhas Sastri

পন্ডিত সুভাষ শাস্ত্রী একজন দিকপাল জ্যোতিষী। দীর্ঘ ৩০ বছর মানুষের সেবা করে আসছেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে গোল্ড মেডেলিস্ট, এছাড়াও তিনি দেশ বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং তার গণনা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বেশ জনপ্রিয়। তিনি কলকাতা, হাওড়া, বীরভূম, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুরে চেম্বার করেন।