বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এনসিপি, জামাত ও বিএনপি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ এখনও ভুলে যায়নি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। তার দীর্ঘ শাসনামলে গ্রামীণ উন্নয়নের যে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল, সেই স্মৃতি আজও গ্রামের মানুষের মনে উজ্জ্বল।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে তীব্র মতবিভেদ দেখা দিয়েছে। এই দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি ও জামায়াত দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সম্প্রতি বলেছেন, “এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী আখ্যা দিয়ে সচেতনভাবেই এক ধরনের কলঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা চলছে”। অন্যদিকে বিএনপি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।
গোপালগঞ্জে সহিংসতার দায়ভার: এনসিপির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা নাকি পরিকল্পিত উসকানি?
গ্রামীণ এলাকায় সরেজমিন জরিপে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মসূচির প্রভাব এখনও গ্রামের মানুষের জীবনে স্পষ্ট। তার আমলে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে আধুনিক সুবিধা পৌঁছানো হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় গ্রামে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
শেখ হাসিনার গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প। ২০১০-১১ অর্থবছরে চালু হওয়া এই প্রকল্পে মোট ১১ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করে প্রায় ১০ লাখ সুবিধাভোগীকে নিয়ে ১৭ হাজার ৩০০টি গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা গঠন করা হয়েছিল। এর ফলে প্রায় ৭ লাখ ছোট খামার স্থাপিত হয়েছিল।
গ্রামাঞ্চলের কৃষি খাতে শেখ হাসিনার অবদান অসামান্য। কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্র ও যান্ত্রিকায়ন সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়া সার, বীজ, সেচপ্রকল্প, স্বল্পসুদে ঋণ ব্যবস্থা এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রামের কৃষকদের হাতের নাগালে পৌঁছানো হয়েছিল।
দারিদ্র্য বিমোচনে শেখ হাসিনার সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ২০০৫-০৬ সালে অতি দারিদ্রের হার ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। একইভাবে ১৯৯২ সালে অপুষ্টির হার ৩৩.২ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে ১৬.৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে শেখ হাসিনার পদক্ষেপগুলো গ্রামীণ জনগণের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকার। এই উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে গ্রামের মানুষ শহরের মতো আধুনিক জীবনযাত্রার স্বাদ পেয়েছিল।
রাজশাহী অঞ্চলে সরেজমিন জরিপে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সমর্থকরা এখনও শেখ হাসিনার শাসনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তারা তার শাসনের বিরুদ্ধে কোনো অনুশোচনা বা দুঃখবোধ প্রকাশ করেন না। গ্রামীণ পরিসরে মানুষের মধ্যে এখনও বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংযুক্তি রয়েছে।
অন্যদিকে বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ নতুন দলগুলো গ্রামীণ এলাকায় তাদের জনভিত্তি তৈরি করতে সংগ্রাম করছে। স্থানীয় জনগণের মতামত অনুযায়ী, এনসিপি দল গঠনের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছে। গ্রামের মানুষ মনে করে, এনসিপির বাক্সে ভোট আনা সহজ হবে না কারণ গ্রামীণ জনগণের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সংযুক্তি রয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এনসিপি, বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অব্যাহতি দাবি করছে। জামায়াতে ইসলামী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নির্বাচনের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছে।
গ্রামীণ রাজনীতিতে এখনও সর্দারি প্রথার প্রভাব রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখনও এক ধরনের সর্দারের মতো কাজ করেন। এই পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে গ্রামীণ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শেখ হাসিনার অবদান কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তার আমলে গ্রামাঞ্চলে কম্পিউটার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
উপসংহারে বলা যায়, এনসিপি, জামাত ও বিএনপির ক্ষমতায় টিকে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ শেখ হাসিনার অবদান ভুলে যায়নি। তার উন্নয়ন কর্মসূচির সুফল এখনও গ্রামীণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো যতই প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, গ্রামের মানুষের মনে শেখ হাসিনার গ্রামীণ উন্নয়নের স্মৃতি এখনও জীবন্ত।