গল্পের জাদুকর ৯০-এ পা দিলেন: শুভ জন্মদিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আজ, ২রা নভেম্বর, ২০২৫, বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি পুরুষ, এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান, শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ৯০তম জন্মদিন। প্রায় সাত দশক ধরে যাঁর কলমের জাদুতে আপামর বাঙালি পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছেন,…

Avatar

 

আজ, ২রা নভেম্বর, ২০২৫, বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি পুরুষ, এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান, শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ৯০তম জন্মদিন। প্রায় সাত দশক ধরে যাঁর কলমের জাদুতে আপামর বাঙালি পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছেন, সেই ‘গল্পের জাদুকর’ আজ জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখলেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় শুধু একজন লেখক নন, তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং অদ্ভুত সব কল্পনার রূপকার। তাঁর সৃষ্টি বড়দের জন্য যেমন গভীর জীবনবোধের সন্ধান দেয়, তেমনই ছোটদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় এক আশ্চর্য ফ্যান্টাসির জগৎ। আনন্দ পাবলিশার্স-এর তথ্য অনুযায়ী, তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কয়েক শতাধিক, যা তাঁর অবিশ্বাস্য সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন। এই বিশেষ দিনে, আমরা ফিরে দেখব তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের পথচলা, তাঁর সৃষ্টির অন্দরমহল এবং বাংলা সংস্কৃতিতে তাঁর অবিস্মরণীয় প্রভাব।

শৈশব থেকে যৌবন: লেখকের ভিত্তি নির্মাণ

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর, ব্রিটিশ ভারতের ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশ)। তাঁর বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সূত্রে শৈশব কেটেছে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন প্রান্তে। এই যাযাবর জীবন তাঁকে দিয়েছে বিচিত্র মানুষ এবং পরিস্থিতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ, যা পরবর্তীকালে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণে প্রভূত সাহায্য করেছে। দেশভাগের যন্ত্রণা এবং ছিন্নমূল হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল, যা তাঁর বিভিন্ন লেখায়, বিশেষত ‘ঘুণপোকা’ বা ‘পার্থিব’-এর মতো উপন্যাসের চরিত্রে ফুটে উঠেছে।

কিশোর বয়সেই তাঁর সাহিত্যপ্রীতির উন্মেষ ঘটে। তবে লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে বেশ কিছুটা দেরিতে, ১৯৫৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তাঁর নিয়তি বাঁধা ছিল অক্ষরের সাথেই। 

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সেরা কিছু গান: বাংলা সঙ্গীতের অমর সৃষ্টি

সাহিত্য জগতে প্রবেশ: ‘জলতরঙ্গ’ থেকে ‘ঘুণপোকা’

তাঁর সাহিত্য জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৯৫৯ সালে, যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। সেই সময় ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়া ছিল এক বিশাল স্বীকৃতির ব্যাপার। কিন্তু লেখক হিসেবে শীর্ষেন্দুকে বাঙালির মননে স্থায়ী আসন দেয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’, যা ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

‘ঘুণপোকা’ ছিল এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। এই উপন্যাসটি ছিল তথাকথিত নায়কহীন, এক বিমর্ষ, হতাশ এবং জীবনবিমুখ যুবকের আত্মকথন। শ্যাম নামের সেই কেন্দ্রীয় চরিত্র, যে নিজের জীবনকে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খায়, তা তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে এক নতুন স্বর নিয়ে আসে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে শীর্ষেন্দু বুঝিয়ে দেন যে তিনি গতানুগতিক ধারার লেখক নন, বরং তিনি জীবনের অন্ধকারতম কোণগুলোকেও সহানুভূতি ও দর্শনের আলোয় বিশ্লেষণ করতে চান। এই উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৭৩ সালে ‘আনন্দ পুরস্কার’-এ ভূষিত হন।

শীর্ষেন্দুর দ্বৈত সত্তা: বড়দের ও ছোটদের সাহিত্য

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যকীর্তিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, উভয় জগতেই তিনি সম্রাট।

বড়দের উপন্যাসে জীবনের গভীর অনুসন্ধান

বড়দের জন্য লেখা তাঁর উপন্যাসগুলি মূলত মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের জটিলতা এবং এক অব্যক্ত আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের কথা বলে।

  • মানবজমিন ও পার্থিব: তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মানবজমিন’ (১৯৮৮) এবং ‘পার্থিব’ (১৯৯৪)। ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এই উপন্যাসগুলি হলো জীবনের এক বিশাল ক্যানভাস। অসংখ্য চরিত্র, তাদের ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাত্রা, প্রত্যেকের নিজস্ব সমস্যা ও তার থেকে উত্তরণের চেষ্টা—সবকিছু মিলেমিশে এক মহাকাব্যিক আখ্যান তৈরি করে। তাঁর লেখায় প্রায়শই এক ‘গুরু’ বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের সন্ধান পাওয়া যায়, যা জীবনের চূড়ান্ত অর্থ খুঁজে বের করার এক রূপক হিসেবে কাজ করে।
  • চরিত্রের জটিলতা: ‘কাগজের বউ’, ‘যাও পাখি’, ‘দূরবীন’ বা ‘অসুখের পরে’-এর মতো উপন্যাসগুলিতে তিনি নাগরিক জীবনের একাকীত্ব, দাম্পত্যের টানাপোড়েন এবং মানসিক জটিলতাকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর চরিত্ররা নিখুঁত নয়; তারা দোষে-গুণে ভরা সাধারণ মানুষ, যা পাঠকদের তাঁদের সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করে।

ছোটদের জগতে অদ্ভুতুড়ে ও গোয়েন্দারা

বাংলা কিশোর সাহিত্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁর আগে পর্যন্ত কিশোর সাহিত্য মূলত অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শীর্ষেন্দু সেই গণ্ডি ভেঙে নিয়ে এলেন এক অদ্ভুতুড়েকে।

  • অদ্ভুতুড়ে সিরিজ: তাঁর সৃষ্ট ‘অদ্ভুতুড়ে’ গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই সিরিজের ভূত বা অলৌকিক চরিত্ররা ভয়ঙ্কর নয়, বরং তারা মজাদার, কিছুটা বোকা, এবং অনেক সময় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’, ‘হেঁশেলে ভূত’, ‘ভূতুড়ে ফুটবল’—এই গল্পগুলি শিশু-কিশোরদের নির্মল আনন্দের পাশাপাশি একধরণের নৈতিক শিক্ষাও দেয়। তাঁর ভূতেরা অনেক বেশি মানবিক। এই ধরণের অশরীরী গল্পের বুনোট বাংলা সাহিত্যে বিরল।
  • মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি: ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। একান্নবর্তী পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হাস্যরস এবং অদ্ভুত সব ঘটনা এই উপন্যাসকে ক্লাসিকের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
  • গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত: যখন বাংলা সাহিত্য ফেলুদা ও ব্যোমকেশে মগ্ন, তখন শীর্ষেন্দু সৃষ্টি করলেন এক ভিন্ন ধারার গোয়েন্দা—লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার শবর দাশগুপ্ত। শবর ফেলুদার মতো মগজাস্ত্রের খেলা বা ব্যোমকেশের মতো সত্যবচনে বিশ্বাসী নন; তিনি একজন পেশাদার পুলিশ অফিসার, যিনি রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অপরাধের মূল উদঘাটন করেন। ‘ঋণ’, ‘আলোয় ছায়ায়’, ‘তীরন্দাজ’-এর মতো শবর সিরিজের উপন্যাসগুলি ডার্ক, গ্রিটি এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। বাংলা ডিটেকটিভ সিনেমা জগতেও শবরের পদার্পণ ঘটেছে এবং তা দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।

সৃষ্টির অন্দরমহল: শীর্ষেন্দুর লেখার ধরণ ও দর্শন

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার একটি নিজস্ব ধরণ (Signature Style) আছে, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

বাস্তব ও পরাবাস্তবের (Magic Realism) মেলবন্ধন

তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তব ও পরাবাস্তবের অদ্ভুত সহাবস্থান। তিনি অবলীলায় বাস্তব ঘটনার মধ্যে অতিপ্রাকৃত বা অবাস্তব উপাদান মিশিয়ে দেন। এই শৈলীকে অনেকেই ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’-এর সাথে তুলনা করেন। তাঁর গল্পে দেখা যায়, কোনো সাধারণ মানুষ হয়তো হঠাৎ উড়তে শুরু করল, বা কোনো মৃত ব্যক্তি ফিরে এসে সাংসারিক কাজে সাহায্য করছে। এই অবাস্তব ঘটনাগুলিকেও তিনি এমনভাবে পরিবেশন করেন যে তা পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় না, বরং তা জীবনেরই এক অংশ হয়ে ওঠে।

চরিত্র নির্মাণের কারিগর

শীর্ষেন্দুর কলমে সাধারণ, ছাপোষা মানুষ অসামান্য হয়ে ওঠে। তাঁর চরিত্ররা প্রায়শই অদ্ভুত, খামখেয়ালী এবং কিছুটা ‘পাগলাটে’। ‘পাগলা সাহেবের কবর’-এর পাগলা সাহেব, বা ‘মানবজমিন’-এর বিভিন্ন চরিত্র—তারা সবাই জীবনের গতানুগতিক ছকের বাইরে। তিনি মানুষের ভেতরের দুর্বলতা, ভয় এবং একইসাথে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছাকে তুলে ধরেন।

হাস্যরস ও গভীর জীবনবোধ

গভীর দার্শনিক তত্ত্বকেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিবেশন করেন এক হালকা হাস্যরসের মোড়কে। তাঁর লেখায় যে হিউমার পাওয়া যায়, তা সস্তা ভাঁড়ামো নয়, তা পরিস্থিতিগত (Situational) এবং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তকেও তিনি এক চিলতে হাসির মাধ্যমে সহজ করে তোলেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক গভীর জীবনদর্শন—মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ক্ষমা এবং ভালোবাসার এক অনন্ত স্রোত।

স্বীকৃতি ও সম্মান: পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা

সাত দশকের দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারগুলি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের প্রমাণ।

পুরস্কারের নাম প্রাপ্তির সাল যে রচনার জন্য (যদি নির্দিষ্ট থাকে)
আনন্দ পুরস্কার ১৯৭৩ প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’-এর জন্য
বিদ্যাসাগর পুরস্কার ১৯৮৫ শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ১৯৮৯ ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য
আনন্দ পুরস্কার (দ্বিতীয়বার) ১৯৯০  
বঙ্গবিভূষণ ২০১২ পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান
সাহিত্য অকাদেমি (শিশু সাহিত্য) ২০১৫ ‘ষষ্ঠীপুরের ষষ্ঠীকান্ড’-এর জন্য

সূত্র: সাহিত্য অকাদেমি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পোর্টাল।

এই তালিকা ছাড়াও তিনি অগণিত সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন, তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের ভালোবাসা।

৯০-তেও কেন তিনি প্রাসঙ্গিক?

আজকের এই ডিজিটাল যুগে, যখন মানুষের মনোযোগ স্মার্টফোনের পর্দায় বন্দী, তখনও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বই কলকাতা বইমেলায় ‘বেস্টসেলার’ তালিকায় থাকে। এর কারণ কী?

ডিজিটাল যুগেও বইয়ের প্রতি আকর্ষণ

কারণ হলো তাঁর গল্পের মূল ভিত্তি—মানুষের আবেগ। টেকনোলজি বদলাতে পারে, কিন্তু মানুষের একাকীত্ব, ভালোবাসা, ভয় বা আধ্যাত্মিক খোঁজের অনুভূতি বদলায় না। শীর্ষেন্দু সেই শাশ্বত আবেগগুলিকে স্পর্শ করেন। তাঁর সহজ, সরল অথচ গভীর গদ্য পাঠকদের টেনে রাখে। তিনি জটিল দর্শনকে সহজবোধ্য করে পরিবেশন করেন, যা সব বয়সের পাঠককেই আকর্ষণ করে। তাঁর লেখা নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

সিনেমার পর্দায় শীর্ষেন্দু

তাঁর সাহিত্য শুধু বইয়ের পাতায় বন্দী থাকেনি, তা সেলুলয়েডের পর্দায় নতুন জীবন পেয়েছে। অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘গয়নার বাক্স’ বা ‘শবর’ সিরিজের চলচ্চিত্রগুলি (পরিচালক অরিন্দম শীল) বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছে। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সফল চলচ্চিত্রায়ণ প্রমাণ করে যে তাঁর গল্প ও চরিত্রগুলি সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক।

স্বর্ণযুগের সুরস্রষ্টা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের অনন্য পরিক্রমা

‘Think Bengal’-এর চোখে শীর্ষেন্দু

‘থিংক বেঙ্গল’-এর এই প্ল্যাটফর্মে আমরা বরাবরই বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের গভীরে যেতে চেয়েছি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য বাংলার সেই মূল সুরটিকেই ধরে রাখে। তাঁর লেখায় যেমন তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের মতো বাংলার মাটির গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনই তাতে নাগরিক জীবনের জটিলতাও উপস্থিত। তিনি রবীন্দ্রনাথের গভীর জীবনদর্শনের উত্তরাধিকারী, আবার একই সাথে তিনি এক মৌলিক স্রষ্টা, যাঁর জাদুকরী কলমে বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা মুছে যায়।

তাঁর ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজের গল্পগুলি বাংলার লোককথার এক আধুনিক সংস্করণ। তিনি দেখিয়েছেন যে ভয় নয়, বরং বিস্ময় ও কৌতূহলই হলো শিশু মনের প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁর শবর দাশগুপ্ত চরিত্রটি দেখায় যে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য শুধু ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সত্যান্বেষীতেই আটকে নেই, তা আধুনিক, রূঢ় বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে সক্ষম।

লেখকের জীবনদর্শন: দীর্ঘ যাত্রার প্রতিচ্ছবি

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ব্যক্তিগত জীবনে শ্রীশ্রী অনুকূলচন্দ্রের অনুগামী। এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাস তাঁর সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে তিনি কখনও তাঁর দর্শন পাঠকের উপর চাপিয়ে দেননি। বরং তাঁর চরিত্রগুলির মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে জাগতিক জীবনের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও এক পরম প্রাপ্তির আশা থাকে।

একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “লেখা আমার কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো।” ৯০ বছর বয়সেও তিনি সমানভাবে সক্রিয়। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি লিখতে বসেন। এই অপরিসীম জীবনীশক্তি এবং সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধতাই তাঁকে ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’ বানিয়েছে। তিনি শুধু একজন লেখক নন, তিনি একজন দ্রষ্টা, যিনি জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসামান্য সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে পারেন।

৯০ বছরের এই দীর্ঘ পথচলায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়েছেন, তা পরিমাপ করা কঠিন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে জীবন যতই জটিল হোক, তার মধ্যে আনন্দ ও বিস্ময়ের উপাদান লুকিয়ে থাকে। তিনি আমাদের অদ্ভুত সব ভূতের গল্প শুনিয়েছেন, আবার ‘মানবজমিন’-এর মতো উপন্যাসে জীবনের গভীরতম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।

বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, বাঙালির মনে ফ্যান্টাসি ও দর্শনের প্রতি আকর্ষণ যতদিন থাকবে, ততদিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তাঁর কলম আজও অক্লান্ত। ‘থিংক বেঙ্গল’-এর পক্ষ থেকে এই কিংবদন্তি সাহিত্যিককে জানাই ৯০তম জন্মদিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রণাম। আপনার কলমের জাদু আমাদের আরও অনেক বছর মুগ্ধ করে রাখুক

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম