শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা হল হিন্দু ধর্মের একটি অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার, যা মহাদেবের দিব্য শক্তিকে মূর্তিতে আহ্বান করে এবং তাঁকে পূজা-অর্চনার উপযুক্ত করে তোলে। এই প্রতিষ্ঠা বিধি প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্য ও আগম শাস্ত্রে বর্ণিত নিয়মানুসারে সম্পন্ন হয়, যেখানে বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ ও পূজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিবলিঙ্গকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার ধর্মীয় তাৎপর্য
বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মধ্যে প্রায় ৩৮.৫ কোটি শৈব সম্প্রদায়ের অনুসারী রয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ৪৪% ভগবান শিবের প্রতি বিশেষ ভক্তি অনুভব করেন এবং শিবলিঙ্গ পূজাকে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উপাসনা হিসেবে গ্রহণ করেন। শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র একটি আচারিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক জাগরণ ও দিব্য আশীর্বাদ লাভের একটি পবিত্র মাধ্যম।
প্রাচীন শাস্ত্র অনুসারে, দেবী পার্বতী ও কার্তিকেয় প্রথম শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেই থেকে মানবজাতি এর আশীর্বাদ লাভ করে আসছে। প্রলয়ের পর মেরু পর্বতের শিখরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ সকল দেবতাদের জন্য ওঙ্কার, কৌমার, ঈশান, বৈষ্ণব, ব্রহ্ম ও প্রজাপতি লোকে বিচরণের সুযোগ দান করেছিল।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক দিক
শিবলিঙ্গ স্থাপন শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, এটি একটি সুসংগঠিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যা বাস্তুশাস্ত্র ও আগম শাস্ত্রে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত রয়েছে। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা মন্দির নির্মাণের সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং এটি একটি সাধারণ কাঠামোকে পবিত্র উপাসনা স্থলে রূপান্তরিত করে।
শিবলিঙ্গের প্রকারভেদ ও উপাদান
প্রাচীন বিশ্বকর্মা দেবতা বিভিন্ন ধরনের শিবলিঙ্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রতিটি উপাদান বিশেষ ফল প্রদান করে। শাস্ত্রে ৪৪টি বিভিন্ন শ্রেণীর শিবলিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে, যা ছয়টি মূল প্রকারে বিভক্ত।
শিবলিঙ্গের উপাদান ও ফলাফল
উপাদান | ফলদায়ক | উদাহরণ |
---|---|---|
শৈলজ (পাথর) | সর্বসিদ্ধি প্রদান করে | নর্মদেশ্বর, স্ফটিক লিঙ্গ |
রত্নজ (রত্নপাথর) | লক্ষ্মী ও সমৃদ্ধি প্রদান করে | ইন্দ্রনীল, পদ্মরাগ, মরকত |
ধাতুজ (ধাতু) | ধনপ্রাপ্তি ঘটায় | সোনা, রূপা, তামা, পিতল |
দারুজ (কাঠ) | ভোগ বা জাগতিক সুখ দেয় | বিভিন্ন পবিত্র কাঠ |
মৃত্তিকা (মাটি) | সর্বসিদ্ধি প্রদান করে | পার্থিব শিবলিঙ্গ |
ক্ষণিক | অস্থায়ী পূজার জন্য | বালি, ভস্ম, দধি, কুশাগ্র |
প্রতিটি দেবতা বিভিন্ন উপাদানের শিবলিঙ্গ পূজা করতেন – বিষ্ণু ইন্দ্রনীল, ইন্দ্র পদ্মরাগ, কুবের স্বর্ণ, বরুণ স্ফটিক, লক্ষ্মী বিল্ব এবং কার্তিকেয় গোময় শিবলিঙ্গ পূজা করেছিলেন।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রস্তুতি
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি প্রয়োজন যা বৈদিক ঐতিহ্যে উল্লেখিত।
প্রাথমিক শুদ্ধি ও প্রস্তুতি
প্রথমে পূজারীকে প্রাতঃকালে উঠে স্নান করে পবিত্র হতে হবে এবং পরিচ্ছন্ন শ্বেত বস্ত্র পরিধান করতে হবে। পূজার স্থান সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করে একটি পবিত্র বেদী বা আসন প্রস্তুত করতে হবে। পূজারীকে কপালে ত্রিপুণ্ড্র বা তিনটি অনুভূমিক রেখায় ভস্ম লাগাতে হবে, যা পরম জ্ঞান, পবিত্রতা ও তপস্যার প্রতীক। রুদ্রাক্ষ মালা পরিধান করা অত্যন্ত শুভ কারণ এটি পূজার সময় শক্তিশালী কম্পন শোষণে সাহায্য করে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ
শ্রেণী | উপকরণ |
---|---|
অভিষেক দ্রব্য | গঙ্গাজল, দুধ (অফুটন্ত), মধু, দধি, ঘৃত, ইক্ষুরস, গোলাপজল |
পঞ্চামৃত | দুধ, দই, মধু, চিনি ও ঘি এর মিশ্রণ |
পূজা সামগ্রী | বেলপত্র, ধুতুরা ফুল, চন্দন, আগরবাতি, কর্পূর, ঘি প্রদীপ |
নৈবেদ্য | ফল, মিষ্টি, বেলফল, নারকেল, পান-সুপারি |
বর্জনীয় | হলুদ, কুমকুম, তুলসীপাতা, নারকেল জল, চম্পা ফুল |
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য রুদ্রাভিষেকে ব্যবহার করা উচিত নয়, যেমন হলুদ, কুমকুম, তুলসীপাতা, নারকেল জল এবং কেওড়া বা চম্পা ফুল।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা মন্ত্র: পঞ্চমুখী রুদ্র মন্ত্র
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার সময় পঞ্চমুখী শিবের পাঁচটি বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। এই মন্ত্রগুলি ভগবান শিবের পাঁচটি মুখের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রতিটি মন্ত্রের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
সদ্যোজাত মন্ত্র
প্রথমে শিবলিঙ্গকে পরিষ্কার জল দিয়ে স্নান করিয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে পীঠে স্থাপন করার পর সদ্যোজাত মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়:
“ওঁ সদ্যোজাতং প্রপদ্যামি সদ্যোজাতাজব নমো নমঃ।
ভবে ভবেনাতি ভবে ভবস্বমাং ভবোদ্ভবয় নমঃ।”
এই মন্ত্র শিবের সৃষ্টিকর্তা রূপের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নতুন শুরুর আশীর্বাদ প্রদান করে।
বামদেব মন্ত্র
পশ্চিম মুখে ত্রিপুণ্ড্র রূপে চন্দন প্রদান করার সময় বামদেব মন্ত্র পাঠ করতে হয়:
“ওঁ বামদেবায় নমঃ, জ্যেষ্ঠায় নমঃ, শ্রেষ্ঠায় নমঃ, রুদ্রায় নমঃ, কালায় নমঃ, কাল বিকরণ্ণায় নমঃ, বল বিকরণায় নমঃ, বলায় নমঃ বল প্রমথনায় নমঃ, সর্ব ভূত দমনায় নমঃ, মনোমনায় নমঃ।”
এই মন্ত্র শিবের রক্ষাকর্তা রূপকে জাগ্রত করে এবং সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে।
অঘোর মন্ত্র
ধূপ ও ধূনা নিবেদনের সময় অঘোর মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়:
“ওঁ অঘোরেভ্যো ঘোরেভ্যো ঘোর ঘোর তরেভ্যঃ।
সর্বেভ্য সর্ব শর্ব্বেভ্যো নমস্তে অস্তু রুদ্র রূপেভ্যঃ।”
এই মন্ত্র শিবের ভয়ংকর রূপকে প্রশমিত করে এবং নেতিবাচক শক্তি বিনাশ করে।
তৎপুরুষ মন্ত্র
ফুল নিবেদনের সময় তৎপুরুষ মন্ত্র পাঠ করতে হয়:
“ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি।
তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ।”
এই মন্ত্র শিব গায়ত্রী নামেও পরিচিত এবং এটি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রদান করে।
ঈশান মন্ত্র
সমস্ত পূজা সম্পন্ন করার সময় ঈশান মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়:
“ওঁ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাম ঈশ্বর সর্বভূতানাম।
ব্রহ্মাদিপতি ব্রহ্মণাধিপতি ব্রহ্ম শিবোমে অস্তু সদা শিবোম।”
এই মন্ত্র শিবের সর্বোচ্চ জ্ঞানী ও সকল বিদ্যার অধিপতি রূপকে আহ্বান করে।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ বিধি
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া যা আগম শাস্ত্র ও বৈদিক ঐতিহ্যে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত।
লিঙ্গ স্থাপন ও দিক নির্ধারণ
শিবলিঙ্গ এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে যোনিপীঠ উত্তরমুখী হয় এবং পূজারী পশ্চিম দিকে মুখ করে পূর্বদিকে তাকিয়ে বসেন। পূজারীকে পশম বা কুশের আসনে বসতে হবে।
প্রাথমিক আচমন ও প্রাণায়াম
আচমন প্রক্রিয়ায় ডান হাতে জল নিয়ে নিম্নলিখিত তিনটি মন্ত্র পাঠের পর প্রতিবার পান করতে হবে:
“ওঁ কেশবায় নমঃ
ওঁ নারায়ণায় নমঃ
ওঁ মাধবায় নমঃ”
তারপর ডান হাতে জল নিয়ে ভূমিতে ফেলতে হবে এই মন্ত্র পাঠ করে:
“ওঁ গোবিন্দায় নমঃ”
এরপর তিন দফায় সংক্ষিপ্ত প্রাণায়াম করতে হবে এই মন্ত্রসহ:
“ওঁ প্রণবস্য পরব্রহ্ম ঋষিহি পরমাত্মা দেবতা।
দৈবী গায়ত্রী ছন্দঃ।
প্রাণায়মে বিনিয়োগঃ।”
গুরু, গণেশ ও কুলদেবতা স্মরণ
ঘি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে গুরু, গণেশ, দেবতা ও পিতা-মাতাকে স্মরণ করতে হবে:
“ওঁ গুরুভ্যো নমঃ
ওঁ গণেশায় নমঃ
ওঁ কুল দেবতাভ্যো নমঃ
ওঁ ইষ্ট দেবতাভ্যো নমঃ
ওঁ মাতা পিতৃভ্যম নমঃ”
এই মন্ত্রগুলির অর্থ: আমি গুরুকে প্রণাম করি, আমি গণেশকে প্রণাম করি, আমি কুলদেবতাকে প্রণাম করি, আমি ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করি, আমি পিতামাতাকে প্রণাম করি।
শুদ্ধিকরণ মন্ত্র
সমস্ত পূজা সামগ্রী ও নিজের উপর জল ছিটিয়ে এই মন্ত্র পাঠ করতে হবে:
“ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্ব বস্তান গতোপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং স বাহ্য ভ্যন্তরঃ শুচি।”
অর্থ: যা অপবিত্র তা পবিত্র হোক, সকল নিম্ন প্রবণতা দূর হোক, যত শীঘ্র সম্ভব আমরা অতিক্রম করি ভিতর ও বাহির পবিত্র হোক।
রুদ্রাভিষেক: শিবলিঙ্গের পবিত্র স্নান
রুদ্রাভিষেক শিব পূজার সবচেয়ে প্রিয় পদ্ধতি যা শিবলিঙ্গের পবিত্র স্নান বোঝায়।
অভিষেক পদ্ধতি
প্রথমে শিবলিঙ্গকে জল দিয়ে স্নান করিয়ে তারপর একে একে সমস্ত অভিষেক দ্রব্য নিবেদন করতে হবে, সর্বদা “ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে:
-
জল অভিষেক: গঙ্গাজল ও গোলাপজল মিশ্রিত জল
-
দুগ্ধ অভিষেক: অফুটন্ত গাভীর দুধ (দীর্ঘায়ু প্রদান করে)
-
ইক্ষুরস অভিষেক: আখের রস বা ফলের রস
-
পঞ্চামৃত অভিষেক: দুধ, দই, মধু, চিনি ও ঘি এর মিশ্রণ (সমৃদ্ধি প্রদান করে)
-
দধি অভিষেক: দই (সন্তান প্রাপ্তিতে সহায়ক)
-
মধু অভিষেক: মধু (দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি)
-
ঘৃত অভিষেক: ঘি (রোগ থেকে রক্ষা)
ষোড়শোপচার পূজা
অভিষেকের পর ষোড়শোপচার বা ষোলটি উপচারে শিবলিঙ্গের পূজা করতে হয়:
আবাহন (আহ্বান): “আবাহনম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
আসন (বসার স্থান): “আসনম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
বস্ত্র: “বস্ত্রম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
চন্দন: “চন্দনম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
অক্ষত: “অক্ষতান সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
পুষ্প ও বেলপত্র: “পুষ্পম, বেলপত্রম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
ধূপ: “ধূপম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
দীপ: “দীপম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
নৈবেদ্য: “নৈবেদ্যম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
তাম্বুল: “তাম্বুলম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
শ্রীফল (নারকেল): “শ্রী ফলম সমর্পয়ামি শ্রী শিব মহাদেবায় চরণ কমলেভ্যো নমঃ”
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র: সর্বশক্তিমান শিব মন্ত্র
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র শিব উপাসনার সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র যা মৃত্যুকে জয় করে এবং দীর্ঘায়ু প্রদান করে। শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার সময় এই মন্ত্র ১০৮ বার রুদ্রাক্ষ মালায় জপ করতে হয়:
“ওঁ হৌম জুম সহ, ওঁ ভূর ভুবঃ স্বঃ
ওঁ ত্র্যম্বকম যজামহে, সুগন্ধিম পুষ্টি বর্ধনম।
উর্বারুকমিব বন্ধনান, মৃত্যোর মুক্ষীয় মামৃতাৎ।
ওঁ স্বঃ ভুবঃ ভূ ওঁ সহ জুম হৌম ওঁ।”
এই মন্ত্রের অর্থ: আমরা ত্রিনেত্র ভগবান শিবের উপাসনা করি যিনি সুগন্ধিযুক্ত এবং সকল জীবের পোষক। যেমন শসা তার লতা থেকে আপনা আপনি বিচ্ছিন্ন হয়, তেমনি তিনি যেন আমাদের মৃত্যুবন্ধন থেকে মুক্ত করেন এবং অমরত্ব প্রদান করেন।
কর্পূর আরতি মন্ত্র
কর্পূর প্রজ্জ্বলন করে এই আরতি মন্ত্র পাঠ করতে হয়:
“কর্পূর শিবম করুণা বতারম সংসার সারম ভুজগেন্দ্রহারম।
সদা বসন্তম হৃদয় রবিন্দে ভবম ভবানী সহিতম নমামি।”
অর্থ: যিনি কর্পূরের মতো শুভ্র এবং করুণার অবতার, যিনি ব্রহ্ম চেতনার স্বরূপ, তিনি শিব আমার হৃদয়ে চিরকাল বাস করেন। আমি তাঁকে এবং ভবানীকে প্রণাম করি।
গায়ত্রী ও সূর্য মন্ত্র
তিনবার গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করতে হয়:
“ওঁ ভূর ভুবঃ স্বঃ
ওঁ তৎ সবিতুর বরেণ্যুম ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো য়োনঃ প্রচোদয়াৎ।”
সূর্য মন্ত্র তিনবার পাঠ করতে হয়:
“ওঁ ভূ ওঁ ভুবঃ ওঁ স্বঃ ওঁ মহঃ ওঁ জনঃ ওঁ তপঃ ওঁ সত্যম।”
সমাপনী প্রার্থনা
শেষে এই শান্তি মন্ত্র পাঠ করতে হয়:
“ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।”
অর্থ: ওটি পূর্ণ, এটিও পূর্ণ, পূর্ণ থেকে পূর্ণের উৎপত্তি। পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করলেও পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার শুভ সময়
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু বিশেষ শুভ সময় রয়েছে যখন এই পূজা করলে অতিরিক্ত ফল পাওয়া যায়:
-
মহাশিবরাত্রি: বছরের সবচেয়ে শুভ দিন
-
শ্রাবণ মাসের সোমবার: শিবের সবচেয়ে প্রিয় দিন
-
প্রদোষ কাল: সন্ধ্যার সময় যা শিবের প্রিয় সময়
-
প্রতি সোমবার: সারা বছর জুড়ে
-
মাসিক শিবরাত্রি: প্রতি মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার ফল ও উপকারিতা
শাস্ত্র অনুসারে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও নিয়মিত পূজায় অসংখ্য আশীর্বাদ পাওয়া যায়:
আধ্যাত্মিক উপকারিতা
যারা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিষ্ঠার সাথে ধ্যান করেন তারা শিবসাযুজ্য বা শিবলোক প্রাপ্ত হন। যারা বৃষভে উপবিষ্ট ও চন্দ্রভূষিত মহাদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন তারা বিমানে চড়ে শিবলোকে যাত্রা করেন। শিব-পার্বতী ও নন্দীসহ শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করলে সূর্যের মতো উজ্জ্বল বিমানে অপ্সরাদের নৃত্যসহ শিবলোকে পৌঁছানো যায়।
পার্থিব উপকারিতা
উপকার | বিবরণ |
---|---|
সকল বিপদ থেকে রক্ষা | শিব ভক্তদের সর্বদা সুরক্ষা প্রদান করেন |
শারীরিক স্বাস্থ্য | রোগব্যাধি ও অসুস্থতা থেকে মুক্তি |
ধন-সম্পদ | সমৃদ্ধি, ধন ও সৌভাগ্য আগমন |
গ্রহদোষ নিবারণ | শনি, রাহুসহ সকল গ্রহের কুপ্রভাব থেকে মুক্তি |
মানসিক শান্তি | মন প্রশান্ত ও শান্ত হয় |
পারিবারিক সম্প্রীতি | পরিবারে শান্তি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় |
সন্তান প্রাপ্তি | যাদের সন্তান হতে সমস্যা তাদের জন্য বিশেষ উপকারী |
ক্যারিয়ারে উন্নতি | চাকরি ও কর্মক্ষেত্রে সুযোগ বৃদ্ধি |
বিখ্যাত শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা স্থান
ভারতে কিছু বিখ্যাত শিব মন্দির রয়েছে যেখানে মহারুদ্রাভিষেক করা যায়:
-
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির, নাসিক: জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির
-
মহাকালেশ্বর মন্দির, উজ্জয়িনী: বিখ্যাত জ্যোতির্লিঙ্গ যেখানে মহাকালেশ্বর রুদ্রাভিষেক অত্যন্ত জনপ্রিয়
-
ওঙ্কারেশ্বর মন্দির, ইন্দোর: পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গ
-
সোমনাথ মন্দির, গুজরাট: প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ
-
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, বারাণসী: সবচেয়ে পবিত্র শিব মন্দির
-
বৈদ্যনাথ মন্দির, দেওঘর: বিখ্যাত জ্যোতির্লিঙ্গ
-
নাগেশ্বর মন্দির, গুজরাট: জ্যোতির্লিঙ্গ
গৃহে শিবলিঙ্গ পূজার নিয়ম
গৃহে শিবলিঙ্গ রাখার জন্য কিছু বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়:
নর্মদেশ্বর, স্ফটিক এবং পারদ শিবলিঙ্গে প্রাণপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না। অন্য শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুরোহিতের মাধ্যমে মন্দিরের শিবলিঙ্গের সাথে এক বা দুই অভিষেকে রাখলে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।
গৃহে নিয়মিত পূজা করার প্রতিশ্রুতি থাকলেই শিবলিঙ্গ রাখা উচিত। প্রাতঃকালে স্নান করে পরিচ্ছন্ন হয়ে শ্বেত বস্ত্র পরে পূজা করতে হবে। জল, দুধ বা পঞ্চামৃত দিয়ে প্রতিদিন অভিষেক করতে হবে এবং বেলপত্র নিবেদন করতে হবে।
শিবলিঙ্গ পূজার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
শিবলিঙ্গ পূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। অভিষেকের সময় উচ্চারিত মন্ত্রের কম্পন বিশেষ শক্তি সৃষ্টি করে যা মন, শরীর ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। বৈদিক মন্ত্রগুলি স্পষ্ট উচ্চারণে পাঠ করলে নিরাময় বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
রুদ্রাক্ষ পরিধান করলে পূজার সময় সৃষ্ট শক্তিশালী কম্পন শোষিত হয় যা চিন্তা প্রক্রিয়া রূপান্তরিত করে এবং পরমাত্মার সাথে সংযুক্ত হতে সাহায্য করে। রুদ্রাক্ষের উচ্চ কম্পন চক্র ভারসাম্য রক্ষা করে এবং উচ্চতর চেতনায় উন্নীত হতে সহায়তা করে।
শিবলিঙ্গ নির্মাণ ও মন্দির স্থাপনের পুণ্য
শাস্ত্র অনুসারে পাথর, টালি, মাটি, সোনা, কাঠ বা সিমেন্ট দিয়ে শিবমন্দির নির্মাণ করলে অসীম পুণ্য লাভ হয়। এটি শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করা হলে তার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। যারা এমন কাজ করেন তারা শিবলোকে বিশেষ স্থান পান এবং মর্ত্য জীবনের পর বিমানে আরোহণ করলে অপ্সরারা তাদের স্বাগত জানায় এবং তারা গানপত্য মর্যাদা লাভ করেন।
ভাঙা, জরাজীর্ণ বা প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য মন্দির পুনর্নির্মাণ, মেরামত বা সংস্কার করলেও উল্লেখযোগ্য অবদান থাকে কারণ রুদ্র ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার তাদের ভূমিকা স্বীকৃতি পায় এবং ইহলোকে তৃপ্তি ও পরলোকে শিবলোকে চিরস্থায়ী মুক্তি দেয়।
শিব মন্দির সেবার গুরুত্ব
যাদের অর্থ নেই বা নতুন শিব মন্দির নির্মাণ বা সংস্কার করার সামর্থ্য নেই তাদেরও মন্দিরে যেকোনো সেবা করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেউ কেউ প্রতিদান সহ বা ছাড়াই মন্দির পরিচালনায় সাহায্য করেন; কেউ প্রদীপের জন্য তেল, অভিষেকের জন্য দুধ দান করেন, কেউ বিনামূল্যে চিত্রকর্ম ও সাজসজ্জার কাজ করেন এবং অন্যান্য ছোট বা বড় কাজ নিজের সামর্থ্য ও ত্যাগ অনুসারে করেন যেমন মন্দির মেঝে পরিষ্কার করা, বাসন ধোয়া এবং অগণিত অন্যান্য সেবা।
শিব তীর্থে মৃত্যুর ফল
শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে কেউ যদি শিব মন্দির থেকে সহজে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে মারা যান, তিনি বার বার চান্দ্রায়ণ ব্রত পালনের পুণ্য লাভ করবেন। যদি কেউ বারাণসী, প্রয়াগ, কেদার, কুরুক্ষেত্র, প্রভাস, পুষ্কর, অমরেশ্বর প্রভৃতি পুণ্য ক্ষেত্রে মারা যান তাহলে সেই ব্যক্তি শিবলোক প্রাপ্তির যোগ্য হবেন।
এই পবিত্র তীর্থগুলির কেবল দর্শন মূল্যবান, কিন্তু শিবলিঙ্গ স্পর্শ করা শতগুণ ভালো; জল দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক শতগুণ উত্তম; দুধ দিয়ে অভিষেক হাজারগুণ ভালো; দই দিয়ে আরও ভালো; মধু দিয়ে আরও উত্তম এবং ঘি দিয়ে অভিষেক সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ।
পঞ্চাক্ষরী মন্ত্রের মহিমা
“ওঁ নমঃ শিবায়” এই পঞ্চাক্ষরী মন্ত্র পাঠ করে কূপ, সরোবর বা নদীতে স্নান করলে ব্রহ্মহত্যা দোষ বা পঞ্চ মহাপাপের একটি নষ্ট হয়। প্রাতঃকালে শিবলিঙ্গ দর্শন করলে উত্তম গতি বা স্বর্গীয় ভ্রমণ পাওয়া যায় এবং সন্ধ্যায় দর্শন করলে যজ্ঞফল পাওয়া যায়।
নীলকণ্ঠ মন্ত্র “ওঁ নমো নীলকণ্ঠায়” একবার অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পাঠ করলে পাপ বিনষ্ট হয় এবং গন্ধ-পুষ্প-কর্পূর-নৈবেদ্য সহ আনুষ্ঠানিক পূজার সাথে ক্রমাগত পাঠ করলে নিশ্চিতভাবে শিবসাযুজ্য লাভ হয়।
শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা মন্ত্র ও বিধি হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র ও শক্তিশালী আচার যা বৈদিক ঐতিহ্য ও আগম শাস্ত্রে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত। বিশ্বের ৪৪% শৈব হিন্দুদের কাছে শিবলিঙ্গ পূজা ও প্রতিষ্ঠা পরম আধ্যাত্মিক সাধনা। সঠিক মন্ত্র উচ্চারণ, বিধিবদ্ধ অভিষেক এবং নিষ্ঠাপূর্ণ ভক্তির সমন্বয়ে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলে ভক্তরা পার্থিব ও পারমার্থিক উভয় প্রকার আশীর্বাদ লাভ করেন।
পঞ্চমুখী রুদ্র মন্ত্র – সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ ও ঈশান – শিবলিঙ্গে প্রাণশক্তি সঞ্চার করে এবং মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র মৃত্যুভয় বিনাশ করে দীর্ঘায়ু ও মোক্ষ প্রদান করে। শ্রাবণ মাসের সোমবার, মহাশিবরাত্রি ও প্রদোষকালে এই বিধি পালন করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কাজ নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানসিক শান্তি, পারিবারিক সম্প্রীতি এবং জীবনে সামগ্রিক সমৃদ্ধি আনয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ পথ।