জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিদিন মাল্টিভিটামিন খাওয়া এবং দীর্ঘায়ু লাভের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। এই গবেষণার ফলাফল গত ২৬ জুন ২০২৪ তারিখে জামা নেটওয়ার্ক ওপেন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এনআইএইচ-এর ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩,৯০,০০০ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কের ২০ বছরের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ছিল ৬১.৫ বছর এবং তাদের কারও কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল না।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. এরিকা লফটফিল্ড বলেন, “আমরা দেখেছি যে যারা প্রতিদিন মাল্টিভিটামিন খেয়েছেন তাদের মৃত্যুঝুঁকি যারা খাননি তাদের তুলনায় কম নয়। এমনকি হৃদরোগ, ক্যান্সার বা স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রেও কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি।”গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন মাল্টিভিটামিন খাওয়া এবং না খাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় একই রকম। বরং মাল্টিভিটামিন খাওয়া লোকদের মৃত্যুঝুঁকি ৪% বেশি পাওয়া গেছে, যদিও এই পার্থক্য পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদরা মনে করেন, মাল্টিভিটামিনের পিছনে খরচ করা অর্থ ফলমূল, শাকসবজি, সম্পূর্ণ শস্যদানা ও কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত খাবারের পিছনে ব্যয় করা বেশি ভালো। তারা বলেন, “পিল খাওয়া উত্তম স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভের শর্টকাট নয়।”তবে গর্ভধারণক্ষম নারীদের ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এটি গর্ভাবস্থার আগে ও শুরুতে শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশজনিত ত্রুটি প্রতিরোধ করে।
এছাড়া কিছু বিশেষ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও মাল্টিভিটামিন উপকারী হতে পারে।গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান পাবলিক হেলথ স্কুলের পুষ্টি ও মহামারী বিজ্ঞান বিষয়ক অধ্যাপক এডওয়ার্ড জিওভানুচি বলেন, “মাল্টিভিটামিন থেকে এমন কিছু পাওয়া যায় না যা একটি ভালো খাবার থেকে পাওয়া যায় না। তবে ভিটামিন ডি-র ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে, যা খাবারে কম থাকে এবং আমরা বেশিরভাগ সূর্যের আলো থেকে পাই।”
কিং’স কলেজ লন্ডনের পুষ্টিবিজ্ঞানী ড. সারা বেরি বলেন, “বেশি মাত্রায় মাল্টিভিটামিন খাওয়া সবসময় ভালো নয়। অনেক মেগা-ডোজ সাপ্লিমেন্ট শুধু দামি নয়, এগুলোতে আমাদের শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ভিটামিন থাকে যা শরীর প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না, ফলে বেশিরভাগই অপচয় হয়ে যায়।”
সাউথহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ইমিউনোলজি বিষয়ক অধ্যাপক ড. ফিলিপ ক্যালডার মনে করেন, “মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্ট স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্প নয় এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রভাব কমাতে ব্যবহার করা যায় না। যদি কারও খাবারে পুষ্টির ঘাটতি থাকে তবেই এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে খাবারের মাধ্যমে পুষ্টি পাওয়াই সবচেয়ে ভালো উপায়।”এই গবেষণার ফলাফল মাল্টিভিটামিন শিল্পের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে।
২০২১ সালে উত্তর আমেরিকায় ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টের বাজার মূল্য ছিল ৫২,৮৭৪.৭ মিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সাল পর্যন্ত এর বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫.৬% বলে আশা করা হচ্ছে।তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই গবেষণার ফলাফল সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি দেখাচ্ছে যে শুধুমাত্র মাল্টিভিটামিন খেয়ে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায় না। বরং স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম ও ভালো ঘুমের মাধ্যমেই সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।গবেষকরা আরও বলেছেন, এই গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এটি একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা, তাই কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারের মতো কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়নি যা ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, এই গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নিয়মিত মাল্টিভিটামিন খাওয়া দীর্ঘায়ু বাড়ায় না। তবে পুষ্টির ঘাটতি আছে এমন ব্যক্তি বা গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এগুলো উপকারী হতে পারে।সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাল্টিভিটামিন খাওয়া উচিত নয়। বরং স্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবনযাপনের মাধ্যমেই সুস্থ থাকার চেষ্টা করা উচিত।