পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সোনালী সুযোগ! জেনে নিন মাসিক ৫০০০ টাকাসহ শ্রমশ্রী প্রকল্পে কী কী সুবিধা পাবেন

স্টাফ রিপোর্টার 5 Min Read

shramshree scheme for migrant workers: বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন রাজ্যে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার ও হেনস্তার প্রেক্ষাপটে সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখে নবান্ন থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘শ্রমশ্রী প্রকল্প’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব বাঙালি শ্রমিক ভিন রাজ্য থেকে নিজের রাজ্যে ফিরে আসতে চান বা ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন, তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।

শ্রমশ্রী প্রকল্প কী এবং এর মূল উদ্দেশ্য

শ্রমশ্রী প্রকল্প হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ভিন রাজ্যে কর্মরত বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্যাদার সাথে ঘরে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি শ্রমিকরা ভাষাগত পরিচয়ের কারণে নিয়মিত হেনস্তা ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য মজুরি ও মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে।

সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই শ্রমিকরাই আমাদের গর্ব। তাঁদের সম্মান রক্ষায় রাজ্য সরকার সর্বতোভাবে পাশে থাকবে।” এই প্রকল্পকে তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য “ঘরে ফেরার সেতু” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

দার্জিলিংয়ে চা শ্রমিকদের বোনাস দাবিতে বন্ধ: মুখ্যমন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারি

শ্রমশ্রী প্রকল্পের অধীনে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে

আর্থিক সহায়তা

এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আর্থিক সহায়তা। যেসব পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরে আসবেন তারা এককালীন ৫,০০০ টাকা যাতায়াত ভাতা হিসেবে পাবেন। এর পাশাপাশি নতুন কাজের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা করে পুনর্বাসন ভাতা দেওয়া হবে, যা সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত প্রদান করা হবে।

স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা

ফিরে আসা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড এবং খাদ্যসাথী কার্ড প্রদান করা হবে। এর ফলে তারা রাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা এবং খাদ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আসবেন। যাদের নিজস্ব বাসস্থান নেই, তাদের জন্য কমিউনিটি কিচেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আবাসন সুবিধা

যেসব শ্রমিকের পাকা বাড়ি নেই, তারা আবাস যোজনার আওতায় গৃহনির্মাণ অনুদান পাবেন। এছাড়াও প্রয়োজনে অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থাও করা হবে।

শিক্ষা সুবিধা

ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। এর ফলে তাদের সন্তানদের শিক্ষায় কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।

দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ

উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্পের মাধ্যমে ফিরে আসা শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর ফলে তারা আরও ভালো কাজের সুযোগ পাবেন এবং স্বনির্ভর হতে পারবেন।

কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ

কর্মশ্রী প্রকল্পের আওতায় জব কার্ড প্রদান করা হবে। দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন কাজে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে এবং ৫০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।

শ্রমশ্রী প্রকল্পে আবেদনের যোগ্যতা

মূল শর্তাবলী

  • আবেদনকারীকে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে
  • যেসব শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার কারণে ফিরে এসেছেন, কেবলমাত্র তারাই এই প্রকল্পের আওতায় আসবেন
  • আবেদনকারীর বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে
  • আবেদনকারীকে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে পরিচিত হতে হবে যিনি বাংলা ভাষা বা পরিচয়ের কারণে অন্য রাজ্যে হেনস্তার শিকার হয়েছেন

সুবিধাভোগীর সংখ্যা

প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিযায়ী পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করা প্রায় ২২ লক্ষ ৪০ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী হবেন। যারা এখনও নাম নথিভুক্ত করেননি, তারাও নতুন শ্রমশ্রী পোর্টালে নিবন্ধন করতে পারবেন।

শ্রমশ্রী প্রকল্পে আবেদনের পদ্ধতি

অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে শ্রমশ্রী পোর্টাল নামে একটি বিশেষ অনলাইন পোর্টাল তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে আগ্রহী শ্রমিকরা সরাসরি অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। সঙ্গে বিশেষ আইডি কার্ড প্রদান করা হবে।

বিকল্প আবেদন পদ্ধতি

  • পরিযায়ী শ্রমিক ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মাধ্যমে আবেদন করা যাবে
  • ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ প্রকল্পের মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ ও নিবন্ধন করা হবে
  • বিডিওরা স্থানীয়ভাবে শ্রমিকদের খোঁজ নিয়ে তাদের সহায়তা করবেন

প্রয়োজনীয় নথিপত্র

আবেদনের সময় নিম্নলিখিত নথিগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে:

  • আধার কার্ড অথবা ভোটার কার্ড
  • ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ (পাসবুকের প্রথম পাতা বা বাতিল চেক)
  • পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা প্রমাণ
  • শ্রমিক হিসেবে কাজ করার প্রমাণপত্র (যদি থাকে)
  • পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং আয়ের উৎস সম্পর্কে তথ্য

প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও তদারকি

মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে এই প্রকল্পের রূপায়ণ ও তদারকির দায়িত্ব সরাসরি রাজ্যের মুখ্যসচিবের হাতে থাকবে। এর ফলে প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও দুর্নীতিমুক্ত পরিচালনা নিশ্চিত হবে।

ইতিমধ্যে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিককে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং ২,৭০০ পরিবার বিভিন্ন রাজ্যে অত্যাচারিত হয়ে ফিরে এসেছে বলে জানা গেছে।

চীনে ‘অন্ধকার কারখানা’র নতুন যুগ: আলো নেই, শ্রমিক নেই, শুধু প্রযুক্তির জয়গান

প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব ও গুরুত্ব

শ্রমশ্রী প্রকল্প শুধুমাত্র একটি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি নয়, এটি একটি মানবিক আশ্বাস ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতীক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে:

  • পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের পরিবারের সাথে থেকে সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারবেন
  • রাজ্যের মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে
  • বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নতি লাভ করবে
  • ভিন রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের উপর অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা পৌঁছাবে

শ্রমশ্রী প্রকল্প বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ যা তাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা – সবকিছু মিলিয়ে এই প্রকল্প পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এক নতুন আশার আলো। যারা ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন বা হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য এটি নিরাপদে ঘরে ফেরার এবং নতুন করে জীবন গড়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

Share This Article