ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চলমান টেস্ট সিরিজে ভারতীয় অধিনায়ক শুভমান গিল অসাধারণ ব্যাটিং পারফরম্যান্সের মাধ্যমে একাধিক ঐতিহাসিক রেকর্ড ভেঙে নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন। ২৫ বছর বয়সী এই পাঞ্জাবি ব্যাটার পাকিস্তানের কিংবদন্তি মোহাম্মদ ইউসুফের ২০০৬ সালে স্থাপিত ৬৩১ রানের রেকর্ড ভেঙে ইংল্যান্ডের মাটিতে এক টেস্ট সিরিজে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী এশিয়ান ব্যাটার হিসেবে নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। ম্যানচেস্টারে চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৩ রানের লড়াকু সেঞ্চুরি করে গিল এখন পর্যন্ত ৬৩২ রান সংগ্রহ করেছেন।
গিলের এই অর্জন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মাইলফলক নয়, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যও গৌরবের বিষয়। ২০০৬ সালে মোহাম্মদ ইউসুফ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪ ম্যাচে ৯০.১৪ গড়ে ৬৩১ রান সংগ্রহ করে যে রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন, তা প্রায় দুই দশক ধরে অটুট ছিল। ইউসুফের ওই সিরিজে দুটি শতক ও একটি দ্বিশতক ছিল, যার জন্য তিনি ২০০৬ সালে ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গিলের শতরানটি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত যখন দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চরম সংকটে পড়েছিল, তখন কেএল রাহুলের সাথে ১৮৮ রানের জুটি গড়ে দলকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যান। ২৩৮ বল খেলে ১২টি চার সহ ১০ৃ রানের এই ইনিংস গিলের মানসিক দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর প্রমাণ।
চলমান সিরিজে গিলের পারফরম্যান্স রীতিমতো বিস্ময়কর। তিনি ইতিমধ্যে চারটি শতরান সম্পন্ন করেছেন, যা কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যানের ৮৭ বছরের পুরনো রেকর্ডের সমান। ব্র্যাডম্যান ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অধিনায়ক হিসেবে এক সিরিজে চারটি শতরান করেছিলেন, এখন গিল সেই রেকর্ডের সমকক্ষে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বার্মিংহামে দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২৬৯ রান ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬১ রান, মোট ৪৩০ রান।
গিলের ব্যাটিং রেকর্ডের তালিকায় আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। তিনি এশিয়ার প্রথম ব্যাটার হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে এক টেস্ট সিরিজে ৭০০ রান অতিক্রম করেছেন। এছাড়াও তিনি এক টেস্ট ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটার হয়েছেন গ্রাহাম গুচের ৪৫৬ রানের পর ৪৩০ রান নিয়ে। এই তালিকায় তিনি ব্রায়ান লারা, কুমার সাঙ্গাকারা ও মার্ক টেলরের মতো কিংবদন্তিদের পিছনে ফেলেছেন।
ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যেও গিল নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছেন। তিনি রাহুল দ্রাবিডের ২০০২ সালের ৬০২ রানের রেকর্ড ভেঙে ইংল্যান্ডে এক সিরিজে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী ভারতীয় ব্যাটার হয়েছেন। এই তালিকায় বিরাট কোহলি (২০১৮ সালে ৫৯৩ রান) ও সুনীল গাভাস্কর (১৯৭৯ সালে ৫৪২ রান) রয়েছেন।
গিলের বর্তমান ফর্ম তার ক্যারিয়ারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিফলন। অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে রান সংগ্রহ করে চলেছেন। ১৯৯৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই ডানহাতি ব্যাটার পাঞ্জাবের প্রতিনিধিত্ব করে ২০১৭-১৮ রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক করেছিলেন। ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। তারপর থেকে তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স ও বর্তমানে গুজরাত টাইটান্সের হয়ে খেলে তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও সফলতার সাথে নাম লিখিয়েছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে গিলের এই অর্জন শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের বিষয় নয়, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্যও আশাব্যঞ্জক। বিদেশের কঠিন পরিস্থিতিতে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এই সাফল্য তার নেতৃত্বের গুণাবলীর প্রমাণ। মোহাম্মদ ইউসুফের মতো মহান ব্যাটারের রেকর্ড ভাঙা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে।
ইউসুফ তার ক্যারিয়ারে পাকিস্তানের হয়ে ৯০টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৭,৫৩০ রান সংগ্রহ করেছিলেন ২৪টি শতরান ও ৩৩টি অর্ধশতক সহ। তার ২০০৬ সালের ইংল্যান্ড সিরিজ ছিল ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। সেই রেকর্ড ভাঙতে গিলের ১৯ বছর লেগেছে, যা তার এই অর্জনের মহত্ত্ব প্রমাণ করে।
বর্তমানে ভারত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-১ গোলে পিছিয়ে রয়েছে। গিলের ব্যাটিং পারফরম্যান্স সত্ত্বেও দলীয় ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। তবে ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে গিল ইতিমধ্যে এই সিরিজকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। বাকি দুটি ম্যাচে তিনি আরও রেকর্ড ভাঙার সুযোগ পাবেন এবং ৭০০ রানের মাইলফলক অতিক্রম করে আরও ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন।
শুভমান গিলের এই সাফল্য ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন প্রজন্মের ব্যাটারদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। তিনি প্রমাণ করেছেন যে কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও সঠিক মানসিকতার মাধ্যমে যেকোনো উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব। পাকিস্তানের মহান ব্যাটার মোহাম্মদ ইউসুফের রেকর্ড ভাঙার মাধ্যমে গিল শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যানগত অর্জন করেননি, বরং এশিয়ান ক্রিকেটে নতুন মান স্থাপন করেছেন।